আখতার-উজ-জামান : মাকে হারানোর আজ ২৬ টি বছর। ১৯৯৪ সালের আজকের দিনে হঠাৎ করে চোখের সামনে সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিটে না ফেরার দেশে চলে গেলেন আমার মা।তখন আরবী জিলহজ্ব মাস ছিলো। হজ্বের তিনদিন পর আল্লাহ পাক রাব্বুল আল-আমীনের ডাকে সাড়া দিয়ে আম্মা আমাদের আট সহোদরকে রেখে একাই চলে গেলেন। প্রতিটি মুহূর্তে স্মরণ করি হৃদয়ের স্পন্দন মায়ের কথা। আম্মা তোমাকে খুব মনে পড়ে। বাবা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে আপনি যেমনটি করে আটটি সন্তানকে লালন পালন করেছেন সেটি আমার দৃষ্টিতে খুবই নজিরবিহীন। আমি তখন ৮ম শ্রেণীতে পড়াশুনা করি। প্রতিদিনের ন্যায় আমার আম্মা ফজর নামায শেষে পুরো বাড়িটির আঙ্গিনা নিজের হাতে ঝাড়–দিতেন। এক তলা ভবন আর টিনসেড বাড়িটির সামনে কিছু ফুলের গাছে (বেইলী, গন্ধরাজ, হাসনেহানা) নিজ হাতে পানি দিতেন। তারপর আমাদের কোন না কোন ভাইকে বলতেন, আমার জন্য চা নিয়ে আয়। তখন সুশান ভাই নাস্তার সাথে আম্মার জন্য চা নিয়ে আসতো। আম্মা নাস্তা-চা-পান সেরে আবার পুকুর ঘাঁটে গিয়ে থালাবাসন ধুয়ে-মুছে সাফ করতেন। কোন কোন সময় আমি আম্মাকে সহযোগিতা করতাম কিছু কাজে। আমার আম্মা সব সময় নিজের কাজ নিজেই করতে পছন্দ করতেন।
১৯৯৪ সালের ২৫ মে, রোজ বুধবার, আরবী জিলহজ্ব মাসের ১৪১৪ সালে ১৪ তারিখ। প্রতিদিনের ন্যায় ঐ দিনও সকাল থেকে আম্মা ব্যস্ত ছিল নিয়ে আমাদের নিয়ে। মিঞা ভাই (রিপন) তার পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকতেন। উচ্চ শিক্ষার জন্য সেখানে দাদা ভাই (লিটন)ও ঢাকার বাসায় থাকতেন। কিন্তু হঠাৎ দাদা ভাই অসুস্থ হলে বাড়িতে চলে আসেন। আম্মা তাঁর দ্বিতীয় সন্তানটির জন্য সারাদিন টেনশন করতেন, আমার লিটনের কি হয়েছে। তোর কি খেতে মন চায়। কি রান্না করবো তোর জন্য। তুই গরুর গোসস্ত খাসনা। তোর জন্য কলমি শাক ভাজি আর পেঁপে ডাল রান্না করবো। এই নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন আমার আম্মা। আমি আর আহসান (সর্বকনিষ্ঠ ছেলে) আম্মার কাছাকাছি থাকতাম। মিলন (মেঝ ভাই) থাকতো আমাদের মার্কেটের নিজ দোকানের কাজে ব্যস্ত। সুশান (সেজ ভাই) ও নোমান বাজারের আশপাশেই ছিল। আরেক ভাই আমান ঢিল ছুঁড়ে মারলো আম গাছে, যদি পাকা আমটি পড়ে যায়।
কিন্তু সেই ঢিল এসে পড়লো পাশের বাড়ির জেঠাতো ভাইয়ের ছেলে পারভেজের মাথায়। তাৎক্ষণিক মাথা ফেটে রক্ত দেখে আম্মা এতোটা কষ্ট পেলেন, যে বারবার আমানকে বোকা দিচ্ছেন তুই করলি কি? কেন গাছে ঢিল মারলি, এখন কি হবে। যাক সেটি কোন রকম ম্যানেজ করলেন আম্মা। তখন দুপুর পৌনে ২টা আমরা সবাই খাওয়া-দাওয়া করলেও আম্মা ঘরের কাজ সেরে নামায আদায় করার জন্য কলপাড়ে (টিউবওয়েল) গেলেন। হঠাৎ আম্মা বলছেন লিটন আমার খুব খারাপ লাগছে, তোরা কে কোথায়। সঙ্গে সঙ্গে ধরাধরি করে বিছানায় নিয়ে আসলাম আমি, দাদা ভাই আর পাসের বাড়ির জেঠি। একি আম্মা এইরকম করছেন কেন? আমরা সবাই দৌড়াদড়ি শুরু করলাম ডাক্তার আনার জন্য। ডাক্তার আনা হলো, তখন ঘড়ির কাটায় সন্ধ্যা ৬:১৫ মিনিট। আমার আম্মা আর নেই। চলে গেলেন পৃথিবী আর আট সন্তানকে রেখে না ফেরার দেশে। হে আল্লাহ আমার আম্মাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুক.. আমীন।