ইসলাম নারীর অগ্রযাত্রা রোধ করতে নয়—তাকে আত্মমর্যাদার আলোয় পথ দেখাতে এসেছে। ইসলাম নারীকে অবমূল্যায়ন করতে নয়; বরং তার সম্মান, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্যই বিধান দিয়েছে। বিধান অনুযায়ী নারীরা পর্দা, শালীনতা ও নিরাপত্তা বজায় রেখে শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, সমাজসেবা—সব ক্ষেত্রেই অংশ নিতে পারে। নারী ও পুরুষ—দুজনের সামঞ্জস্যপূর্ণ অংশগ্রহণে সমাজ হয় পরিপূর্ণ, সুন্দর ও শক্তিশালী।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে— অনেকেই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা না জেনে বলে বেড়ান যে, ইসলাম নারীদের ঘরে বন্দি থাকতে বলে। অথচ সত্য হলো— ইসলাম নারীর সম্ভাবনা বিকাশের পথ বন্ধ করেনি; বরং সুরক্ষিত, সম্মানজনক ও সুশৃঙ্খল পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। নারীর মর্যাদা রক্ষার যে কাঠামো ইসলাম দিয়েছে, তা কোনো শৃঙ্খল নয়—বরং এক আগলানো ভালোবাসা, নিরাপত্তা আর সম্মানের ছায়া। তাই প্রশ্ন ওঠে—ইসলাম কি সত্যিই নারীকে ঘরে বন্দি থাকতে বলে?
উত্তর হলো—‘না’, ইসলাম নারীকে বন্দি করে না; বরং তাকে সম্মানিত, মর্যাদাবান ও সুরক্ষিত হওয়ার পূর্ণ অধিকার দেয়। বরং নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করেই মহান আল্লাহ ঘরের বাইরে যাওয়ার দিকনির্দেশনা এভাবে দেন-
یٰۤاَیُّهَا النَّبِیُّ قُلۡ لِّاَزۡوَاجِکَ وَ بَنٰتِکَ وَ نِسَآءِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ یُدۡنِیۡنَ عَلَیۡهِنَّ مِنۡ جَلَابِیۡبِهِنَّ ؕ ذٰلِکَ اَدۡنٰۤی اَنۡ یُّعۡرَفۡنَ فَلَا یُؤۡذَیۡنَ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا
‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের, মেয়েদের ও বিশ্বাসীদের নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের (মুখমন্ডলের) উপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে (বিশ্বাসী নারী হিসেবে) চেনা সহজতর হবে; তাহলে তাদেরকে অহেতুক উত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আহজাব: আয়াত ৫৯)
নারীর আল্লাহর বিধান মেনে ঘরের বাইরে যেতে পারবে।
ইসলাম নারীকে সব সময় ঘরে আবদ্ধ হয়ে থাকতে বলে না। বরং নিয়ম মেনে ঘরের বাইরে যাওয়ার দিকনির্দেশ দেয়। ঘরের বাইরে যাওয়া কিংবা কোনো কাজে অংশগ্রহণ করা নারীর জন্য নিষিদ্ধ নয়। এতে ইসলামের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। এ সম্পর্কে হাদিসে পাকে রয়েছে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা-
> হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-
إِنَّهُ قَدْ أُذِنَ لَكُنَّ أَنْ تَخْرُجْنَ لِحَاجَتِكُنَّ
‘অবশ্যই প্রয়োজনে তোমাদের (নারীদের) বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।’ (বুখারি ৪৭৯৫)
হজর ওমর (রা.) রাতের বেলা এক নারীকে প্রয়োজনীয় কাজ করতে বের হতে দেখে কিছু বলেছিলেন। তখন ঐ নারী বিষয়টি রাসুল (সা.)-কে জানালে তিনি এ হাদিসটি বর্ণনা করেন। এটি নারীর চলাফেরা সম্পর্কে ইসলামের সবচেয়ে শক্তিশালী দলিলগুলোর একটি।
তবে বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে যদি দূরের কোনো গন্তব্যে যেতে হয় তবে সে ক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে একজন মাহরামের সঙ্গে যাওয়ার দিকনির্দেশনা দেয় ইসলাম। কারণ দূরযাত্রায় কোনো পুরুষ অভিভাবক না থাকলে যে কোনো নারীর জন্যই এ ভ্রমণ বিপজ্জনক হতে পারে। এ সম্পর্কেও হাদিসে পাকে এসেছে-
> হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মাহরামের উপস্থিতি ছাড়া কোনো পুরুষ কোনো নারীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারবে না। (এ সময়) এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন- ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমার স্ত্রী হজে বেরিয়ে গেছে। আর (নির্ধারিত কিছু) জিহাদে অংশগ্রহণের জন্য আমার নাম তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। এ কথা শুনে নবী (সা.) নির্দেশ দিলেন, ‘ফিরে যাও এবং স্ত্রীর সঙ্গে হজ সমাপন কর।’ (বুখারি)
এ হাদিস থেকে বুঝায় যায়, দূরের কোনো সফর হলে নারী সঙ্গে একজন মাহরাম পুরুষ সঙ্গী থাকা আবশ্যক। যে কারণে রাসুলুল্লাহ (সা.) জিহাদে অংশগ্রহণে নাম লেখানো সাহাবিকেও এ মর্মে অব্যহতি দিয়েছেন যে, হজের দূরের সফরে যেন নারীকে (স্ত্রীকে) সঙ্গ দিতে পারে। এখানে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি দেখা হয়েছে।
ফিকহি ব্যাখ্যা ও মতামত
১. নারীর বাইরে যাওয়া বৈধ, যদি —
> শালীনতা বজায় থাকে
> অপ্রয়োজনীয় মেলামেশা না হয়
> নিরাপত্তা থাকে
> উদ্দেশ্য বৈধ হয়
> পোশাক পর্দাশীল হয়
২. ‘হাজাহ’ (প্রয়োজন) কী কী?
ফিকহবিদদের মতে—
> চিকিৎসা
> শিক্ষা
> বাজার করা
> আত্মীয়-স্বজন দেখা
> কর্মসংস্থান (শরয়ি শর্ত পূরণে)
> সাক্ষ্য প্রদান
> সামাজিক দায়িত্ব পালন— সবই প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত।
৩. হাদিসটি নারীর ঘরে বন্দিত্বের ধারণাকে বাতিল করে
ইসলাম নারীর চলাফেরা নিষিদ্ধ করেনি; বরং শালীনতা ও নিরাপত্তার কাঠামোর মধ্যে অনুমতি দিয়েছে।
৪. এটি নারীর সম্মান রক্ষার দলীল
ইসলাম নারীর চলাফেরাকে সীমাবদ্ধ করে না— বরং সুরক্ষিত, দায়িত্বশীলভাবে চলতে শেখায়।
৫. হাদিস থেকে শিক্ষণীয় বিষয়
> নারীর বাইরে যাওয়া স্বাভাবিক ও অনুমোদিত
> ইসলাম নারীর ক্ষমতায়নকে স্বীকৃতি দেয়
> পর্দা ও শালীনতা নারীর অগ্রগতির প্রতিদ্বন্দ্বী নয়
> নারীর স্বাধীনতা ইসলামের কাঠামোর মধ্যেই নিরাপদ
সুতরাং ইসলাম নারীকে ঘরে বন্দি করে রাখার কোনো মতবাদ প্রচার করে না—এ কথা দৃঢ়ভাবে বলা যায়। বরং ইসলাম নারীর সম্মান, নিরাপত্তা এবং মর্যাদা নিশ্চিত করে তাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছে। নারী যেন নিজের ব্যক্তিত্ব, আস্থা ও সম্ভাবনা নিয়ে সমাজে অবদান রাখতে পারে—ইসলাম সেই পথটিই পরিষ্কার করে দিয়েছে।
যারা না বুঝে বলে বেড়ান যে ইসলাম নারীকে ঘরে আটকে রাখে—তারা ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য থেকে অনেক দূরে। কারণ ইসলাম নারীকে বাঁধে না, বরং তাকে সুরক্ষার আলোয় ঢেকে রাখে, সম্মানের আসন দেয় এবং দায়িত্বশীলভাবে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি দেয়।
অতএব, সত্যটি এটাই— ইসলাম নারীর চলার পথ বন্ধ করে না; বরং তার মর্যাদা রক্ষার শর্তসাপেক্ষে পথকে আরো নিরাপদ, সুন্দর ও আলোকিত করে তোলে।

