ইসলাম শুধু বাহ্যিক কর্ম বা আনুষ্ঠানিক ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি একজন বান্দার অন্তরের ভালোবাসা, বিশ্বাস ও আন্তরিকতার প্রকাশও বটে। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে একজন মানুষের বাহ্যিক আমল তার হৃদয়ের অবস্থার ওপর নির্ভরশীল।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন— “নিশ্চয়ই কাজের প্রতিফল নিয়তের ওপর নির্ভর করে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১)
একজন মুমিনের হৃদয়ের দশটি গুরুত্বপূর্ণ আমল নিচে তুলে ধরা হলো—
১️⃣ إخلاص (ইখলাস বা আন্তরিকতা)
ঈমানের পর একজন মুমিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হৃদয়ের কাজ হলো ইখলাস। অর্থাৎ শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা, মানুষের প্রশংসা বা সমালোচনার পরোয়া না করা।
আল্লাহ বলেন—
“তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কেবল আল্লাহর উপাসনা করার জন্য, আন্তরিকভাবে তাঁর দীন কায়েম করার জন্য, নামাজ প্রতিষ্ঠা ও যাকাত প্রদানের জন্য।” (সূরা আল-বাইয়্যিনাহ: ৫)
আরও বলেন—
“বলুন, আমার নামাজ, কোরবানি, জীবন ও মৃত্যু— সবই আল্লাহর জন্য, যিনি সমগ্র জগতের প্রতিপালক।” (সূরা আল-আনআম: ১৬২-১৬৩)
২️⃣ توكل (তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর ওপর ভরসা)
সব পরিস্থিতিতে আল্লাহর ওপর পূর্ণ নির্ভর করাকে তাওয়াক্কুল বলা হয়।
“বলুন, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তাঁর ওপরই আমি নির্ভর করি, এবং তিনি মহান আরশের মালিক।” (সূরা আত-তাওবাহ: ১২৯)
৩️⃣ رجاء (রজাআ বা আশা)
সবসময় আল্লাহর অনুগ্রহের আশা রাখা ও তাঁর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়া।
“আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না কেবল অবিশ্বাসীরাই।” (সূরা ইউসুফ: ৮৭)
৪️⃣ خوف (খাওফ বা ভয়)
আল্লাহর ভয় হৃদয়ে রাখা।
ইবন কুদামা (রহ.) বলেছেন— “ভয় হচ্ছে আল্লাহর চাবুক, যার মাধ্যমে তিনি বান্দাকে জ্ঞান ও কর্মের দিকে পরিচালিত করেন।”
আল্লাহ বলেন— “আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই তাঁকে ভয় করে।” (সূরা ফাতির: ২৮)
৫️⃣ شكر (শোকর বা কৃতজ্ঞতা)
আল্লাহর নিয়ামতের স্মরণ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
“স্মরণ রাখ, যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, আমি অবশ্যই তোমাদের আরও বেশি দেব; কিন্তু অকৃতজ্ঞ হলে আমার শাস্তি কঠিন।” (সূরা ইব্রাহিম: ৭)
৬️⃣ رضا (রিদা বা সন্তুষ্টি)
আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা এবং নিজ আমলে তাঁর সন্তুষ্টি খোঁজা।
“কেউ কেউ নিজেদের আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করে, আর আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অতি দয়ালু।” (সূরা আল-বাকারা: ২০৭)
৭️⃣ صبر (সবর বা ধৈর্য)
পরীক্ষা ও বিপদের সময় ধৈর্য ধরাই মুমিনের মূল গুণ।
“হে মুমিনগণ! ধৈর্য ধরো, ধৈর্যে প্রতিযোগিতা করো এবং সর্বদা প্রস্তুত থাকো। আল্লাহকে ভয় করো যাতে তোমরা সফল হও।” (সূরা আলে ইমরান: ২০০)
৮️⃣ محاسبة (মুহাসাবা বা আত্মসমালোচনা)
নিজের আমল পর্যালোচনা করা, যা পাপ থেকে বাঁচায় এবং আত্মশুদ্ধির সুযোগ দেয়।
“যেদিন প্রত্যেকে নিজের করা ভালো-মন্দ কাজ উপস্থিত দেখবে, সে চায়বে— যেন তার ও কাজের মধ্যে বিশাল দূরত্ব থাকত।” (সূরা আলে ইমরান: ৩০)
৯️⃣ تفكر (তাফাক্কুর বা চিন্তন)
আল্লাহর সৃষ্টি ও মহিমা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা।
“যারা দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আসমান-জমিনের সৃষ্টিতে চিন্তা করে বলে— হে আমাদের পালনকর্তা, আপনি এগুলো নিরর্থক সৃষ্টি করেননি।” (সূরা আলে ইমরান: ১৯১)
🔟 محبة (মাহাব্বাহ বা ভালোবাসা)
আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এবং সেই ভালোবাসার মাপকাঠিতে অন্যকে ভালোবাসা।
“কিছু মানুষ আল্লাহ ছাড়া অন্যকে তাঁর সমতুল্য মনে করে এবং তাদেরকে আল্লাহর মতো ভালোবাসে। কিন্তু যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।” (সূরা আল-বাকারা: ১৬৫)
এই দশটি হৃদয়ের আমল একজন মুমিনের অন্তর্নিহিত আত্মিক জগৎকে দৃঢ় করে এবং বাহ্যিক আমল ও ইবাদতের মান উন্নত করে।

