১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের হামলার পর নিজেদের দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নেন লাখ লাখ আফগান নাগরিক। পাকিস্তানে বসবাসকারী আফগান শরণার্থী আল্লাহ মীরের মা–বাবাও একই পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন। তারা দেশ ছেড়ে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কোহাটে একটি শরণার্থী গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। সেখানেই মীরের জন্ম।
বর্তমানে মীরের বয়স ৪৫ বছর। তার ২০০ জনেরও বেশি স্বজন আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তখন থেকে সেখানেই তাঁদের ঘরবাড়ি।
দুই বছর ধরে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ লক্ষাধিক আফগান শরণার্থীকে দেশে ফেরত পাঠাতে তৎপরতা চালাচ্ছে। এমন অবস্থায় মীরদের পরিবার নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কে আছে। এত দিন তারা ইসলামাবাদে ধরপাকড় থেকে কোনোভাবে বেঁচে থাকলেও গত সপ্তাহে তাদের ওপর বিপদের ছায়া নেমে এসেছে।
গত সপ্তাহে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে, দেশজুড়ে থাকা ৫৪টি আফগান শরণার্থী গ্রামের সব কটিই বন্ধ করে দেবে তারা। এটি ২০২৩ সালে শুরু হওয়া অভিযানেরই অংশ। ওই অভিযানের লক্ষ্য হলো ‘অবৈধ বিদেশিদের’ দেশ থেকে বিতাড়িত করা। ৫৪টি শরণার্থী গ্রামের মধ্যে কোহাটের গ্রামগুলোও আছে, যেখানে মীর ও তাঁর পরিবার বসবাস করে।
আল–জাজিরাকে মীর বলেন, ‘আমার জীবনে আমি মাত্র একবারের জন্য আফগানিস্তানে গিয়েছিলাম। সেটা ২০১৩ সালে, দুই সপ্তাহের জন্য গিয়েছিলাম। এর বাইরে আমার পরিবারের কেউ আর কখনো সেখানে ফিরে যায়নি। আমি কী করে সব ছেড়ে চলে যাব, যখন আমরা এখানেই জন্মেছি, এখানেই বড় হয়েছি, এখানেই বিয়ে করেছি এবং প্রিয়জনদের এখানেই দাফন করেছি?’
২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর পাকিস্তানের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কে উত্তেজনা দেখা দেয়। এই টানাপোড়েনের মধ্যেই মীরের মতো অসংখ্য পরিবার অনিশ্চয়তার ঘূর্ণিতে আটকা পড়েছে।
অক্টোবরের শুরুতে সীমান্তে আফগান ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। এতে দুই দেশের মধ্যকার টানাপোড়েন প্রকাশ্য শত্রুতায় রূপ নেয়। গত রোববার দোহায় দুই পক্ষের কর্মকর্তারা বৈঠকে বসে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ২৫ অক্টোবর ইস্তাম্বুলে তাদের পরবর্তী বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
এরপরও উত্তেজনা চলছে। মীরের মতো পরিবারগুলোর আশঙ্কা, তারা দুই প্রতিবেশী দেশের এই সীমান্ত সংঘাতের কূটনৈতিক খেলায় বলি না হয়ে যায়। স্বাগত থেকে বিতাড়ন
আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের হামলার পর থেকেই পাকিস্তান লাখ লাখ আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে এবং ১৯৯৬ সালে তালেবান প্রথমবার ক্ষমতায় এলে বহু আফগান নাগরিক সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে আসেন। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার পর আফগানিস্তানে শুরু হওয়া মার্কিন আগ্রাসন এবং তালেবানের পতনের পর কিছু আফগান স্বদেশে ফিরে যান। তবে তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
২০২১ সালের আগস্টে হঠাৎ করে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা দখল করলে আবারও পাকিস্তানের দিকে এক বিশাল শরণার্থী ঢল নামে। ছয় থেকে আট লাখ আফগান নাগরিক পাকিস্তানে আশ্রয় নেন।
তবে গত চার বছরে কাবুল ও ইসলামাবাদের সম্পর্ক খুব খারাপ হয়ে যায়। একসময় তালেবানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত পাকিস্তান এখন অভিযোগ করছে, সীমান্ত হামলার জন্য দায়ী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দিচ্ছে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার। এর পর থেকে পাকিস্তানের নীতি কঠোর করা হয়েছে। এমনকি যাঁরা মীরের মতো দশকের পর দশক ধরে পাকিস্তানেই বাস করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও কঠোর নীতি প্রয়োগ করা হচ্ছে।
১০ সন্তানের জনক মীর পেশোয়ারের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সহায়তায় আফগান শরণার্থী শিশুদের জন্য একটি কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রকল্প পরিচালনা করছেন।
২০০৬ সাল থেকে ইউএনএইচসিআর পাকিস্তানে বসবাসকারী আফগান নাগরিকদের জন্য প্রুফ অব রেজিস্ট্রেশন (পিওআর) কার্ড ইস্যু করে আসছে। এই কার্ডগুলো তাদের পাকিস্তানে বৈধভাবে থাকা সম্ভব করেছে, কিছুটা চলাচলের স্বাধীনতা দিয়েছে এবং সীমিত আকারে হলেও কিছু সরকারি সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে।
তবে চলতি বছরের ৩০ জুন থেকে পাকিস্তান সরকার পিওআর কার্ড নবায়ন বন্ধ করে দিয়েছে এবং বিদ্যমান কার্ডগুলোকে অকার্যকর বলে ঘোষণা করেছে।
মীর বলেন, ‘আমাদের সবারই ইউএনএইচসিআরের ইস্যু করা প্রুফ অব রেসিডেন্স কার্ড আছে। কিন্তু এখন এই অভিযান শুরু হওয়ায় আমি জানি না আমাদের কী হবে।’

