২০১৯ সালে রমজানে পবিত্র কাবা প্রাঙ্গণে ‘মক্কা আল-মুকাররমা সনদ’ সম্মেলন হয় মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগের উদ্যোগে। সেখানে ১৩৯টি দেশের প্রায় ১২০০ মুফতি ও ইসলামি পণ্ডিতগণ মক্কা আল-মুকাররমা সনদ স্বাক্ষর করেন। সনদের ধারা ২৯টি; যা ‘বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শান্তি ও ঐক্যের সনদ’ স্বীকৃতি পেয়ে বাদশা ফয়সাল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। মূল সনদটি আরবি থেকে অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক। দুই পর্বের আজ শেষ পর্ব। ১৫. ইসলামভীতি মূলত ইসলামের প্রকৃত সত্তা, তার সভ্যতাগত অবদান ও মহান উদ্দেশ্য সম্পর্কে অজ্ঞতার ফল। ইসলামের প্রকৃত চেতনা উপলব্ধি করতে হলে পক্ষপাতহীন ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন—যা পূর্বধারণা ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত। ইসলামকে বোঝা উচিত তার মৌলিক নীতি ও ভিত্তির আলোকে, কিছু বিপথগামী ব্যক্তির আচরণ বা ইসলামের নামে সংঘটিত অন্যায়ের ভিত্তিতে নয়, যা ইসলামি শরিয়তের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না বরং তা তার বিকৃতি।
১৬. উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা এবং মহৎ সামাজিক আচরণকে উৎসাহিত করা সবার দায়িত্ব। তেমনি পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে নৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও মানবিক সংকটগুলোর মোকাবিলা করাও জরুরি, যা ইসলামি ও সর্বজনীন মানবিক মূল্যবোধের আলোকে সম্পন্ন হওয়া উচিত।
ব্যক্তিস্বাধীনতা কখনোই মানবিক মূল্যবোধের ওপর আঘাত হানার বা সামাজিক কাঠামো ধ্বংস করার অজুহাত হতে পারে না। স্বাধীনতা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।
১৭. ব্যক্তিস্বাধীনতা কখনোই মানবিক মূল্যবোধের ওপর আঘাত হানার বা সামাজিক কাঠামো ধ্বংস করার অজুহাত হতে পারে না। স্বাধীনতা ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। প্রত্যেকের স্বাধীনতাচর্চা সংবিধান, আইন ও সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এবং সামষ্টিক বিবেকের ভারসাম্য বজায় রেখে অন্যের মূল্যবোধ ও অধিকারের সীমারেখায় থেমে যেতে।
১৮. রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ একটি অগ্রহণযোগ্য অনুপ্রবেশ। বিশেষত রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি বা অন্য কোনো আধিপত্যবাদী প্রয়াসের মাধ্যমে তা আরও অনুচিত। তেমনি কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ বা সম্প্রদায়ভিত্তিক চিন্তা চাপিয়ে দেওয়া, কিংবা স্থান, পরিস্থিতি ও স্থানীয় রীতিনীতি উপেক্ষা করে ফতোয়া আরোপ করার চেষ্টাও অনুমোদিত নয়।
কোনো হস্তক্ষেপ কেবল শরিয়তের অনুমোদিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করা যেতে পারে, এবং তা হতে হবে সরকারি আনুষ্ঠানিক অনুরোধের ভিত্তিতে, যেমন—হুমকিপ্রদ, বিদ্রোহী বা নাশকতাকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, পুনর্গঠন, রক্ষা, সহায়তা বা অন্যান্য বৈধ উদ্দেশ্যে।
১৯. বৈশ্বিক সফল উন্নয়নমূলক অভিজ্ঞতাগুলোকে অনুসরণযোগ্য মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করা উচিত, যা সব ধরনের দুর্নীতি প্রতিরোধ করে। এই উদ্যোগগুলো পূর্ণ স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে এবং সেই ব্যবহারমূলক প্রবণতাগুলো পরিবর্তন করে যা উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে, অর্থনৈতিক সম্পদ নিঃশেষ করে বা সম্পদের অপচয় ঘটায়।
২০. মুসলিম সমাজকে সুরক্ষিত রাখা: এটি শিক্ষা ও শিক্ষাদান প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব, যেখানে পাঠ্যক্রম, শিক্ষক ও প্রাসঙ্গিক উপকরণ, সব ধরনের প্রভাবক প্ল্যাটফর্ম এবং বিশেষ করে জুমার খুতবা এবং সুশীল সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তর্ভুক্ত।
এদের মূল কাজ হলো মুসলিমদের ধর্মীয় সচেতনতা বৃদ্ধি করা, তাদেরকে মধ্যপন্থা ও সমতার নীতিতে শিক্ষিত করা এবং সতর্ক করা যেন তারা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংঘাত, জাতির মধ্যে হতাশা সৃষ্টি, অথবা অন্যদের প্রতি অসত্য বা অতিরঞ্জিত ধারণা গ্রহণে জড়িয়ে না পড়ে। ২১. সব ধর্মীয়, নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মধ্যে নিরাপদ ও সমতার ভিত্তিতে সম্মিলিত জীবন নিশ্চিত করা মানবসমাজের জন্য অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সব আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা প্রয়োজন এবং যেকোনো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা মানবিক সাহায্য প্রদানে মানুষকে ধর্ম, জাতি বা অন্য কোনো ভিত্তিতে বৈষম্য না করা অপরিহার্য।
২২. সমন্বিত নাগরিকত্ব: সমন্বিত নাগরিকত্বের দাবিটি ইসলামিক ন্যায়বিচারের মূলনীতি দ্বারা পরিচালিত হয়, যা জাতীয় বৈচিত্র্যের সব স্তরকে অন্তর্ভুক্ত করে। এতে সংবিধান ও আইনকে সম্মান জানানো হয়, যা জাতীয় অনুভূতির একমত বা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।
রাষ্ট্রও এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল এবং নাগরিকদের সত্যানুগ আনুগত্য, সামাজিক নিরাপত্তা ও শান্তি রক্ষা, নীতি ও পবিত্রতাকে সম্মান করার কর্তব্য রয়েছে। এসব দায়িত্ব পারস্পরিক অধিকার ও ন্যায়সংগত নিয়মের ভিত্তিতে প্রয়োগ হয়, যার মধ্যে ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যও অন্তর্ভুক্ত।
২৩. উপাসনালয় বা ধর্মীয় স্থানগুলোর ওপর আক্রমণ একটি অপরাধমূলক কাজ। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তামূলক গ্যারান্টি প্রয়োজন। পাশাপাশি এর উৎসাহ দানকারী চরমপন্থী ভাবনাগুলোরও প্রতিরোধ করা আবশ্যক।
আল্লাহর সীমার মধ্যে নারীর বৈধ ক্ষমতায়ন হলো তার একটি মৌলিক অধিকার। তাকে কোনোভাবেই হীনভাবে দেখা, তার মর্যাদা অবমাননা করা, তার অবস্থান হ্রাস করা বা তার স্বাধীনতা ও স্বীকৃতিতে বাধা সৃষ্টি করা যায় না।
২৪. মানবকল্যাণমূলক উদ্যোগ সম্প্রসারণ ও ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগ, অজ্ঞতা, নৃশংসতা ও পারস্পরিক অবনতির বিরুদ্ধে কার্যকর উদ্যোগ ও প্রোগ্রাম প্রচার এবং তাদের সফল বাস্তবায়ন সব দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি, ধর্মীয়, স্বেচ্ছাসেবী এবং মানবিক কাজে জড়িত সক্রিয় ব্যক্তিরা। এ ধরনের উদ্যোগ মানুষের মর্যাদা রক্ষা এবং তাদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণে সহায়ক।
২৫. আল্লাহর সীমার মধ্যে নারীর বৈধ ক্ষমতায়ন হলো তার একটি মৌলিক অধিকার। তাকে কোনোভাবেই হীনভাবে দেখা, তার মর্যাদা অবমাননা করা, তার অবস্থান হ্রাস করা বা তার স্বাধীনতা ও স্বীকৃতিতে বাধা সৃষ্টি করা যায় না। এটি ধর্মীয়, বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক, সামাজিক বা অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
নারীকে কোনো বৈষম্য ছাড়া তার প্রাপ্য স্থান ও মর্যাদা দিতে হবে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বেতন ও সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা। সবকিছু তার প্রকৃতি এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে, সবাইকে ন্যায়সংগত ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করে করা হবে। যদি এই ন্যায় ও সমতা কার্যকর না করা হয়, তবে এটি নারীর প্রতি এবং সাধারণভাবে সমাজের প্রতি একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। ২৬. শিশুর স্বাস্থ্য, শারীরিক ও মানসিক বিকাশ এবং শিক্ষাগত যত্ন: শিশুর প্রতি যত্ন নেওয়া হলো রাষ্ট্র, সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এবং পরিবারদের প্রাথমিক দায়িত্ব। বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে শিশুর চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠন, যা তার দৃষ্টি প্রসারিত করবে, ক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়াবে। শিশুকে সৃজনশীলভাবে কাজ করার সুযোগ, যোগাযোগের দক্ষতা অর্জনের সুযোগ এবং বিকৃত আচরণ বা পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে রক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
২৭. মুসলিম যুবসমাজের পরিচয় তার পাঁচটি ভিত্তি: ধর্ম, দেশ, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ভাষার আলোকে দৃঢ়করণ এবং তা সচেতন বা অবচেতনভাবে বিলীনকরণের প্রচেষ্টা থেকে সংরক্ষণ করা অপরিহার্য। এটার জন্য যুবসমাজকে সভ্যতা সংঘাত, অন্যমতের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্ররোচনা এবং চরমপন্থী চিন্তাভাবনার সহিংসতা বা সন্ত্রাস থেকে সুরক্ষা দিতে হবে।
একই সঙ্গে, যুবসমাজের যোগাযোগ ও আন্তসম্পর্কের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে, যা ইসলামের বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি ও হৃদয়গ্রাহী শিষ্টাচার অনুসারে পরিচালিত হবে। তাদের সহমর্মিতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং অন্যের অস্তিত্ব, মর্যাদা ও অধিকার বোঝার শিক্ষা দিতে হবে। এ ছাড়া যুবসমাজকে তাদের বসবাসরত দেশের আইন ও নিয়ম মেনে চলা এবং উপকারী সহযোগিতা ও বিনিময় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যা ইসলামের মানবিক নীতিমালার উচ্চতম আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এই সংবিধি প্রণেতারা একটি বিশ্বব্যাপী মঞ্চ বা ফোরাম (ইসলামিক উদ্যোগ) প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব তুলে ধরেন, যা বিশেষভাবে যুবসমাজের বিষয় নিয়ে কাজ করবে। এটির কার্যক্রমের মধ্যে থাকবে: ইসলামের অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত উভয় দিকের যুবসমাজের সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপ ও আলোচনা স্থাপন, যুবসমাজের সব চাহিদা, সমস্যা এবং দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট ও খোলাখুলি স্বীকার ও গ্রহণ করা।
যুবসমাজকে সভ্যতা সংঘাত, অন্যমতের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্ররোচনা এবং চরমপন্থী চিন্তাভাবনার সহিংসতা বা সন্ত্রাস থেকে সুরক্ষা দিতে হবে।
এ কাজ সম্পাদনের জন্য ব্যবহৃত হবে দক্ষতা ও জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষামূলক পদ্ধতি, যা যুবসমাজের পর্যায়, আবেগ ও অনুভূতিকে বোঝার মতো সমন্বিত ও ভারসাম্যপূর্ণ ভাষায় আলোচনার সুযোগ প্রদান করবে। এটি অতীতের ভুল বা নেতিবাচক ফলের পুনরাবৃত্তি এড়াতে, অতীতের অভিজ্ঞতা ও ক্ষতিকর শাখা কার্যক্রম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে।
২৮. কেবল সিদ্ধান্ত, বাগ্মিত্মক উদ্যোগ, কার্যক্রম এবং তাত্ত্বিক ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা নয়; বরং লক্ষ্য হওয়া উচিত কার্যকর ও বাস্তব ফলাফল অর্জন, যা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা শক্তিশালী করে এবং ধ্বংসাত্মক কৌশল, নৃজাতিগত নিপীড়ন, জোর করে বাস্তুচ্যুতি, মানব পাচার ও অবৈধ গর্ভপাতের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
২৯. মুসলিম উম্মাহর বিষয়াদি চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তার ধর্মীয় ও সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে বক্তব্য প্রদানের অধিকার শুধু অভিজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠিত আলেমদের সম্মিলিতভাবে রয়েছে—যে স্তরের আলেম এই সংবিধি গ্রহণের জন্য এই সম্মেলনে একত্র হয়েছেন এবং তাদের কিবলায় বরকতময় উপস্থিতির মাধ্যমে এটি বিশেষত্ব লাভ করেছে।
ধর্মীয় ও মানবিক কাজে সবার কল্যাণ নিশ্চিত করতে, ধর্ম, নৃজাতি বা রং নির্বিশেষে, কোনো বর্জন বা বৈষম্য ছাড়া সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা আবশ্যক।