শুধু দুটি সিনেমা দিয়েই প্রদীপ রঙ্গনাথন নিজের জায়গা তৈরি করেছেন। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি ক্লিপে এক সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি হিরো দেখতে প্রথাগত নায়কদের মতো নন। কিন্তু শুধু দুই ছবিতেই এত ভক্ত-অনুসারী অর্জন করা বিরল। এটা কি পরিশ্রম, নাকি ভাগ্য?’ এই প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রদীপের খ্যাতির বিষয়টি। আসলেই তো, মাত্র দুই সিনেমা দিয়েই বড় বড় দক্ষিণি তারকার মধ্যেকীভাবে এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন প্রদীপ?
আজকের সময়ে যখন বড় তারকার সিনেমাও দর্শককে ছুঁতে পারছে না, তরুণদের সিনেমাও কমে গেছে; এক সিনেমার ঘোষণা থেকে মুক্তি নেওয়া পর্যন্ত বছর লাগছে, সেখানে প্রদীপ রঙ্গনাথনের এই সাফল্য কেবল ভাগ্য বা পরিশ্রম নয়; এখানে রয়েছে কৌশলগত ব্যাপারও। তরুণ প্রজন্মকে বোঝা
প্রদীপের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হলো এই সময়ে তরুণদের গল্প বলা। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে দেখা গেছে, যেসব অভিনেতা প্রথমে যুব দর্শকদের মন জয় করেছেন, পরবর্তী সময়ে পরিবারের অন্যান্য সদস্যের কাছেও তাঁরা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন।
উদাহরণস্বরূপ, বলা যায় সুরিয়ার কথা। অভিনেতা ‘ভারানাম আয়িরাম’ ও ‘সিল্লুনু ওরু কাধাল’ সিনেমা দিয়ে তরুণদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলেন। একইভাবে বিজয়ও তাঁর ‘খুশি’ ও ‘সাচিয়েন’ দিয়ে, পবন কল্যাণ ‘বাদরি’ ও ‘মুরারি’ দিয়ে তরুণ প্রজন্মের নায়ক হয়ে ওঠেন। একই ঘটনা ঘটেছে মহেশ বাবু ও প্রভাসের ক্ষেত্রেও। বিজয় দেবরকোন্ডাও ‘পেলি ছুপুলু’ আর ‘অর্জুন রেড্ডি’র মাধ্যমে তাঁর সময়ের তরুণদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পান।
প্রদীপও এই কৌশল কাজে লাগিয়েছেন ‘লাভ টুডে’র মাধ্যমে। হাস্যরস ও ডিজিটাল যুগের অরাজকতার আড়ালে লুকিয়ে আছে আধুনিক যুবক প্রজন্মের সম্পর্কের উদ্বেগ—বিশ্বাস, স্বচ্ছতা ও প্রকাশের ভয়; এই হলো সিনেমার মূল সুর। স্বাভাবিকভাবেই জেন-জি দর্শকেরা পছন্দ করেছেন সিনেমাটি। ছবিতে দেখা যায়, এক যুগল একদিন একে অপরের ফোন ব্যবহার করে! এর মাধ্যমে প্রদীপ আঘাত করেন সবচেয়ে সংবেদনশীল জায়গায়: গোপনীয়তা, সততা, কৌতূহল। এই প্রাসঙ্গিক গল্প প্রথমে কলেজশিক্ষার্থী ও তরুণ পেশাজীবীদের কাছে পৌঁছায়। পরে পরিবারের অন্য সদস্যরাও ছবিটি দেখে বলেন, ‘বাহ, সচেতনতার গল্প হিসেবে খারাপ নয়।’ এই কৌশলটি প্রদীপ নিখুঁতভাবে প্রয়োগ করেছেন।
প্রজন্মকে বোঝা অভিনেতা-পরিচালক
প্রদীপ শুধু অভিনয় করেন না; তিনি মুহূর্ত তৈরি করেন। ‘লাভ টুডে’-এ রোমান্টিক সংঘাত থাকলেও সিনেমার মূল শক্তি হলো তারুণ্যের উচ্ছ্বাস ও সচেতনতা। ছবির গানগুলো শুধু গান নয়, বরং মেজাজ, জীবনধারা ও অনুভূতির প্রতিফলন।
‘ড্রাগন’ ছবিটি যদিও তিনি পরিচালনা করেননি, তবু তাঁর প্রভাব চরিত্রায়ণে দৃশ্যমান। সিনেমার চরিত্র রাঘবন ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র। তাঁর মাধ্যমে প্রদীপ তরুণ প্রজন্মের দ্বন্দ্ব, লালসা ও ভুল সিদ্ধান্তের বাস্তবতা তুল ধরেছেন।
প্রদীপের আসল শক্তি
প্রদীপ সিনেমায় সচেতনতার গল্প বলেন, বাস্তবতা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন; কিন্তু জ্ঞান দেন না। তিনি হিরো হিসেবে দেখাতে চান না; তিনি বাস্তব হতে চান। এই বাস্তবধর্মী নির্মাণ স্টাইল তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।
নতুন যুগের পরিকল্পনা
আজকের সিনেমা শুধুই গল্প নয়, প্যাকেজিংও বিক্রি করে। প্রদীপ টিপিক্যাল হিরো নন; তাঁকে দেখেই মনে হয়, পাশের বাড়ির কেউ। তাঁর সিনেমা বাবা-মেয়ের আবেগ, প্রেম ও সামাজিক বার্তার সমন্বয় ঘটিয়ে সব ধরনের দর্শকের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছেন। প্রদীপের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও জনমুখী প্রচারণাও একই লাইন ধরে চলে। তিনি নিজের আলাদা ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন। তাঁর সিনেমার প্রচারণামূলক ভিডিওগুলোও মজার। এখন যখন সবাই ‘প্যান-ইন্ডিয়া’ স্বপ্ন দেখে, কিন্তু প্রদীপের কৌশল দক্ষিণেই থাকা। সিনেমার প্রচার সেভাবেই করেন। তাঁর সিনেমার বাজেট থাকে কম, তিনি জানেন, দক্ষিণের মানুষ ছবি পছন্দ করলেই বিনিয়োগের কয়েকগুণ উঠে আসবে।
‘আমাদের মধ্যে একজন’
প্রদীপের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো পর্দার ও বাস্তবের মধ্যে সেতুবন্ধ। পর্দায় তিনি প্রতিটি দর্শকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন, অফ-স্ক্রিনও একই বিষয় ধরে রাখেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষ আমার মধ্যে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। তারা দেখছে, তারা প্রেম করছে, তারা লড়ছে। তখন আমি ইতিমধ্যেই হিরো।’
নাগার্জুনও সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, ‘কয়েক দশক আগে রজনীকান্ত সিনেমা বদলে দিলেন। পরে ধনুশ। এখন প্রদীপে সেই জ্বালা দেখছি। ওকে দেখে মনে হয় আমাদেরই একজন।’
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ
প্রদীপ এখন যতই জনপ্রিয় হোন সিনেমার দুনিয়া কঠিন। একটি ভুল সিদ্ধান্তই হয়তো অনেক কিছু বদলে দিতে পারে। প্রদীপ সেটা ভালোই জানেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমার মূল শক্তি সততার সঙ্গে গল্প বলা। সামনেও এটা ধরে রাখতে চাই।’