ঢাকার মাঠে ৭ গোলের রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে হৃদয় ভাঙার স্মৃতি এখনও দগদগে। সেই ক্ষতের ওপর প্রলেপ দিতে এবং এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এক নতুন চেহারার বাংলাদেশ দল আগামীকাল হংকং চায়নার মুখোমুখি হচ্ছে। প্রতিশোধের এই অগ্নিপরীক্ষায় দলের সঙ্গী হয়েছে একঝাঁক নতুন স্বপ্ন—বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা একদল তরুণ প্রবাসী প্রতিভা, যারা লাল-সবুজ জার্সির ভবিষ্যৎ বদলে দেওয়ার বার্তা দিচ্ছেন।
বদলে যাওয়া বাংলাদেশ: হামজার পাশে জায়ান, শমিতদের ঘিরে নতুন স্বপ্ন
সাম্প্রতিক বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় হলো প্রবাসী খেলোয়াড়দের অন্তর্ভুক্তি। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হামজা চৌধুরী মাঝমাঠে যোগ দিয়ে দলের চেহারাই পাল্টে দিয়েছেন। তাঁর বিশ্বমানের উপস্থিতি, বল নিয়ন্ত্রণ এবং খেলা তৈরির ক্ষমতা বাংলাদেশকে নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। তাঁর পাশাপাশি কানাডা প্রবাসী মিডফিল্ডার শমিত সোম ঢাকার প্রথম লেগেই গোল করে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছেন।
দলের দীর্ঘদিনের রক্ষণ দুর্বলতা কাটানোর আশা হয়ে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তরুণ লেফট-ব্যাক জায়ান আহমেদ। অনূর্ধ্ব-২৩ দলে দুর্দান্ত পারফর্ম করে সিনিয়র স্কোয়াডে জায়গা করে নেওয়া এই তরুণ এখন কোচের অন্যতম ভরসা। ইতালি প্রবাসী ফরোয়ার্ড ফাহমিদুল হক এবং বসুন্ধরা কিংসে খেলা কিউবা মিচেলের মতো প্রতিভারাও জাতীয় দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় থাকায়, বাংলাদেশ ফুটবলে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। এই নতুন শক্তির ওপর ভর করেই হংকংয়ের দুর্গ ভাঙার স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ।
বাস্তবতার কাঁটা: র্যাংকিং, পরিসংখ্যান এবং কোচ-গোলরক্ষক সংকট
স্বপ্নের বিপরীতে বাস্তবতা বেশ কঠিন। ফিফা র্যাংকিংয়ে হংকং (১৪৬) বাংলাদেশের (১৮৪) চেয়ে ৩৮ ধাপ এগিয়ে এবং ঘরের মাঠে তারা নিঃসন্দেহে ফেবারিট। তবে মাঠের প্রতিপক্ষের চেয়েও বাংলাদেশের বড় দুশ্চিন্তা এখন দলের অভ্যন্তরীণ সংকট নিয়ে।
কাঠগড়ায় কোচ হাভিয়ের কাবরেরা:
প্রায় তিন বছর ধরে দায়িত্বে থেকেও স্প্যানিশ কোচ হাভিয়ের কাবরেরা একটি স্থিতিশীল রক্ষণভাগ তৈরি করতে পারেননি—এই অভিযোগ এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। ঢাকার মাঠে ৪ গোল হজম তাঁর কৌশলকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অভিজ্ঞ গোলরক্ষক আনিসুর রহমান জিকোকে বসিয়ে রেখে তরুণ মিতুল মারমাকে খেলানোর মতো বিতর্কিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি তীব্রভাবে সমালোচিত। রক্ষণভাগের সমন্বয়হীনতা এবং ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সঠিক পরিবর্তন আনতে না পারার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এই ম্যাচটি তাঁর জন্যও অগ্নিপরীক্ষা।
গোলপোস্টের নিচে আস্থার সংকট:
তরুণ গোলরক্ষক মিতুল মারমা ঢাকার ম্যাচে ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তাঁর অবস্থানগত ভুল এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব দলকে ভুগিয়েছে। আন্তর্জাতিক ম্যাচের চাপ সামলাতে তিনি কতটা প্রস্তুত, সেই প্রশ্ন উঠে গেছে। তাঁর মতো প্রতিভাবান গোলরক্ষককে এমন কঠিন সময়ে মাঠে নামিয়ে তাঁর আত্মবিশ্বাস পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে কি না, তা নিয়েও ফুটবল মহলে চলছে গুঞ্জন।
শেষ কথা: প্রতিশোধ না পুনরাবৃত্তি?
একদিকে প্রবাসী খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া এক নতুন, উদ্যমী আক্রমণভাগ; অন্যদিকে, কোচের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত আর রক্ষণ ও গোলপোস্টের নিচে আস্থার সংকট—এই দুই বিপরীত চিত্র নিয়েই মাঠে নামবে বাংলাদেশ। যদি রক্ষণভাগ তাদের পুরনো ভুলগুলো শুধরে নিতে পারে এবং হামজা-মোরসালিনরা মাঝমাঠ ও আক্রমণে নিজেদের সেরাটা দিতে পারেন, তবে যেকোনো কিছুই সম্ভব।
আগামীকালের ম্যাচটি তাই শুধু ৯০ মিনিটের খেলা নয়, এটি বাংলাদেশ ফুটবলের মান-অভিমান, নতুন স্বপ্ন এবং পুরনো শঙ্কার এক মহাকাব্যিক লড়াই। ফলাফল যা-ই হোক, কোটি ফুটবলপ্রেমীর চাওয়া—মাঠে লড়াকু এক বাংলাদেশকে দেখতে পাওয়া।