ইসলামে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার মতো দৈনন্দিন কাজও এর ব্যতিক্রম নয়। ইসলামে খাওয়ার আগে ও পরে দোয়া পড়ার বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে, যা মুসলিমদের জন্য শুধু শিষ্টাচারই নয়, বরং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আধ্যাত্মিক সংযোগের একটি মাধ্যম।
মুসলিম পরিবারে শিশুদের ছোটবেলা থেকেই এই দোয়া ও শিষ্টাচার শেখানো হয়, যাতে এটি তাদের জীবনের অংশ হয়ে যায় এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও এই অভ্যাস অটুট থাকে।
যারা খাওয়ার আগে আল্লাহর নাম নিতে ভুলে যায়, তাদের খাবারে শয়তান শরিক হতে পারে। খাওয়ার আগে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা শয়তানের হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করে এবং খাবারকে বরকতময় করে।
দোয়ার তাৎপর্য
খাওয়ার আগে ও পরে দোয়া পড়া মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি সুন্নাহ। এই দোয়া পড়ার পেছনে গভীর আধ্যাত্মিক ও ব্যবহারিক কারণ রয়েছে।
প্রথমত, এটি আল্লাহ তাআলার দেওয়া রিজিকের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি মাধ্যম। খাদ্য ও পানীয় আল্লাহর নেয়ামত, এবং দোয়ার মাধ্যমে মুসলিমরা এই নেয়ামতের প্রতি শুকরিয়া আদায় করে।
দ্বিতীয়ত, ইমাম মুসলিম বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে, যারা খাওয়ার আগে আল্লাহর নাম নিতে ভুলে যায়, তাদের খাবারে শয়তান শরিক হতে পারে। খাওয়ার আগে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা শয়তানের হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করে এবং খাবারকে বরকতময় করে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২০১৮)
তৃতীয়ত, এই দোয়াগুলো খাবারকে আধ্যাত্মিক ও শারীরিকভাবে পুষ্টিকর করে তোলে। এটি শুধু খাদ্য গ্রহণের কাজ নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একটি ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়।খাওয়ার আগে ও পরে দোয়া
খাওয়ার আগের দোয়া: খাওয়ার আগে বলতে হয়, বিসমিল্লাহ। অর্থ: আল্লাহর নামে। উমর ইবনে আবু সালামা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “খাওয়ার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর (বিসমিল্লাহ বল), ডান হাত দিয়ে খাও এবং তোমার সামনের অংশ থেকে খাও।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭৩৭৬)
এই দোয়া খাবারকে বরকতময় করে এবং শয়তানের প্রভাব থেকে রক্ষা করে। যদি কেউ খাওয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে যায়, তবে খাওয়ার মাঝখানে স্মরণ হলে বলতে পারে, বিসমিল্লাহি আওয়ালাহু ওয়া আখিরাহু। অর্থ: আল্লাহর নামে শুরু ও শেষ। (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৩৮৯৪)
খাওয়ার পরের দোয়া: খাওয়ার পর বলতে হয়, আলহামদুলিল্লাহিল্লাজি আতআমানি হাজা ওয়া রাঝাকানিহি মিন গাইরি হাওলিম মিন্নি ওয়ালা কুওয়াহ। অর্থ: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাকে এই খাদ্য খাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন এবং আমার কোনো শক্তি বা ক্ষমতা ছাড়াই আমাকে এই রিজিক দান করেছেন। (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩২৮৫)
এই দোয়াগুলো খাবারকে কেবল শারীরিক পুষ্টি নয়, বরং আধ্যাত্মিক তৃপ্তিও প্রদান করে। এগুলো পড়ার মাধ্যমে মুসলিমরা আল্লাহর প্রতি তাদের নির্ভরতা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।ইসলামে খাওয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কিছু শিষ্টাচার, যা সুন্নাহর অংশ। এই শিষ্টাচারগুলো মুসলিমদের জীবনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সম্মানজনক করে।
খাওয়ার ইসলামি শিষ্টাচার
ইসলামে খাওয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কিছু শিষ্টাচার, যা সুন্নাহর অংশ। এই শিষ্টাচারগুলো মুসলিমদের জীবনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সম্মানজনক করে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিষ্টাচার উল্লেখ করা হলো:
খাওয়ার আগে হাত ধোয়া: খাওয়ার আগে দুই হাত ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে। এটি শুধু স্বাস্থ্যের জন্যই নয়, সুন্নাহর অংশও।
ডান হাতে খাওয়া: খাওয়া ও পান করার সময় ডান হাত ব্যবহার করা সুন্নাহ।
মিতাচারে খাওয়া: অতিরিক্ত খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। মহানবী (সা.) বলেছেন, পেটের এক-তৃতীয়াংশ খাবার, এক-তৃতীয়াংশ পানি এবং এক-তৃতীয়াংশ খালি রাখা উচিত।
দাঁড়িয়ে না খাওয়া: বসে খাওয়া ও পান করা সুন্নাহ। দাঁড়িয়ে খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
খাবারের সমালোচনা না করা: খাবারের দোষ ধরা বা অপচয় করা ইসলামে নিষিদ্ধ। খাবার যেমনই হোক, তা গ্রহণ করা উচিত।
খাওয়ার পর হাত ধোয়া: খাওয়ার পর হাত ধুয়ে নেওয়া এবং দোয়া পড়া সুন্নাহ।
ইসলামি শিক্ষা ও শিষ্টাচারের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আধুনিক বিশ্বে, যেখানে দ্রুত জীবনযাত্রা ও ফাস্টফুড সংস্কৃতি প্রাধান্য পাচ্ছে, তখনও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে খাওয়ার শিষ্টাচার ও দোয়ার প্রতি গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
অনেক মুসলিম পরিবার তাদের সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই এই শিক্ষা দিয়ে থাকে। এমনকি প্রযুক্তির যুগেও, সামাজিক মাধ্যমে এই দোয়া ও শিষ্টাচার শেয়ার করা হচ্ছে, যা নতুন প্রজন্মের মধ্যে ইসলামি মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিচ্ছে।