নদীর তীরে নোঙর করা আছে বড়সড় স্টিলের নৌকা। কাঠের তৈরি ছোট সিঁড়ি বেয়ে নৌকায় উঠছে শিক্ষার্থীরা। ছাউনি দেওয়া বড় নৌকার ভেতরে সারি সারি বেঞ্চ পাতা। সেখানেই পড়াশোনা করছে শিশুরা।
এটি আসলে ভাসমান বিদ্যালয়। প্রাক্-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয় এখানে। পাঠদানের পাশাপাশি বিনা মূল্যে বই-খাতা, কলম, জ্যামিতি বক্স, স্কুল ড্রেস, ব্যাগ, জুতা, টিফিন ও স্বাস্থ্যসেবাও দেওয়া হয়ে থাকে। এভাবেই হাওরে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে নৌকায় ভাসা আটটি স্কুল। নৌকাগুলোয় শিক্ষার্থীদের বিনোদনের জন্য খেলাধুলারও আয়োজন করা হয়। কিশোরগঞ্জের নিকলীর ঘোড়াউত্রা নদীপারের দুটি ইউনিয়নের শিশুদের জন্য এসব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ভাসমান স্কুলগুলো। কাদের জন্য ভাসমান স্কুল
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঘোড়াউত্রা নদীপারের অনগ্রসর দুটি ইউনিয়নের নাম ছাতিরচর ও সিংপুর। দুই ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ কৃষি ও মৎস্যজীবী। দারিদ্র্যসীমার নিচে তাঁদের বাস। আর্থিক সংকটের কারণে এক সময় অনেক পরিবারের ছেলেমেয়ে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল।
হাওরের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে এমন নাজুক পরিস্থিতি নজরে আসে বেসরকারি সংস্থা পিপলস ওরিয়েন্টেড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশনের (পপি)। ২০১০ সালের দিকে শুরু করে সংস্থাটি পর্যায়ক্রমে ছাতিরচর ইউনিয়নে চারটি এবং সিংপুর ইউনিয়নে চারটি, মোট আটটি নৌকায় ভাসমান স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। এর মধ্যে সাতটি স্কুল একতলা এবং একটি স্কুল দোতলা। এসব ভাসমান স্কুলগুলোয় শিশুশ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে শিক্ষা উপকরণসহ নানা সেবা প্রদানের দায়িত্ব নেয়।
ভাসমান স্কুলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসার জন্য ঘাটে ঘাটে যাওয়ার জন্য নৌকার ব্যবস্থা আছে। সকাল ৮টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত চলে এসব ভাসমান স্কুলের ক্লাস। লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশুদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ ও পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী করে তুলতে প্রতিটি স্কুলে আছে পাঠাগার, শিক্ষণীয় ফটো গ্যালারি ও বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন। বর্তমানে আটটি ভাসমান স্কুলে ৩৬০ জন শিক্ষার্থী আছে। এসব স্কুল থেকে ইতিমধ্যে সাফল্যের সঙ্গে অনেক শিক্ষার্থী প্রাথমিক পর্ব শেষ করেছে।
কী বলছেন শিক্ষার্থী–অভিভাবকেরা
ছাতিরচর ভাসমান স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাবিহা আক্তার বলে, ‘বর্ষাকালে ভাসমান স্কুলটি বাড়িরঘাটে থাকায় আমাদের পড়ালেখা করতে অনেক সহজ হয়। কাছে থাকাতে বৃষ্টির দিনেও স্কুলে যেতে সমস্যা হয় না।’ পঞ্চম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী আমির হোসেন বলে, ‘স্কুল থেকেই আমাদের বিনা মূল্যে বই-খাতা, কলম, জ্যামিতি বক্স, স্কুল ড্রেস, ব্যাগ, জুতা, টিফিন দেওয়া। এতে আমাদের পড়ালেখা অনেক সুবিধা হয়।’
কথা হয় কাশিপুর ভাসমান স্কুলের শিক্ষক মোজাহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের তাঁরা সন্তানের মতো আন্তরিকভাবে পাঠদান করেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রদের নৌকা দিয়ে নিয়ে এসে ভাসমান স্কুলে পড়ানো হয়। পাঠদান শেষে আবারও নৌকা দিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
কাশিপুর গ্রামের অভিভাবক জেবুন্নেছা আক্তার বলেন, এখানকার বেশির ভাগ লোকে অভাব-অনটনে জীবন চলে। এই গ্রামে সরকারি কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। বিদ্যালয় দূরে থাকায় বাচ্চাদের পড়াশোনায় সমস্যা হতো। পপির ভাসমান স্কুল হওয়ায় ছেলেমেয়েদের আর দূরে গিয়ে কষ্ট করে পড়তে হয় না। বাড়ি লাগোয়া জলেভাসা স্কুলেই তারা পড়তে পারছে।
মানবিক উদ্যোগে খুশি সবাই
পপির ভাসমান স্কুল প্রকল্পের সমন্বয়কারী মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ইতিমধ্যে তাঁদের ভাসমান স্কুল থেকে ১৫শর বেশি শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছে। তাদের অনেকেই এখন দেশের বিভিন্ন মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করি শিক্ষার্থীদের খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে পড়াতে। শিক্ষকদেরও এইভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে।’
এ বিষয়ে কথা হয় পপির নির্বাহী পরিচালক মুর্শেদ আলম সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রত্যন্ত হাওরাঞ্চলে শিক্ষার বিষয়টি চিন্তা করে নিকলীর ভাঙনকবলিত এলাকা ছাতিরচর ও গোড়াদিঘায় ২০১০ সালে প্রথম দুটি ভাসমান স্কুল চালু করা হয়। দিন দিন চাহিদা বাড়ায় এখন সুবিধাবঞ্চিত অন্যান্য গ্রামেও এসব স্কুল চালু করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৫ সালে নিকলীর সিংপুর ইউনিয়নের বিদ্যালয়বিহীন গ্রাম কাশিপুরে একটি ভাসমান স্কুল চালু করা হয়। এ নিয়ে শুধু নিকলীতেই বর্তমানে আটটি স্কুল চালু রয়েছে। ভবিষ্যতে পার্শ্ববর্তী হাওরে অন্যান্য এলাকাগুলোয়ও এসব স্কুল চালুর উদ্যোগ আছে।
হাওর এলাকায় শিক্ষা প্রসারে পপির এমন মানবিক উদ্যোগে খুশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। ছাতিরচর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান চৌধুরী জানালেন, ভাসমান স্কুলগুলো হওয়ায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে। হাওরের প্রত্যন্ত এলাকার শিশুদের মধ্যে শিক্ষার এমন আলো ছড়ানোর এই উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।
নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেহেনা মজুমদার বলেন, হাওরের ভাঙনকবলিত এলাকায় ছাতিরচর ও সিংপুরে যেসব ভাসমান স্কুল হয়েছে, সেগুলো খুবই ভালো উদ্যোগ। এসব স্কুল হওয়ায় হাওরের শিশুরা অনেক সহজেই বাড়ির পাশে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে। যেসব এলাকায় স্কুল না থাকায় শিশুরা পড়তে পারত না। তারাও এখন ভাসমান স্কুলে পড়তে পারছে।