দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ, যেখানে ইবনে তাইমিয়া পাঠদান করতেনছবি: উইকিপিডিয়া
ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ইসলামি চিন্তাবিদ ও পণ্ডিত। তাঁর পুরো নাম আহমদ বিন আবদুল হালিম, তবে তিনি শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া নামে অধিক পরিচিত। তাঁর প্রপিতামহীর নাম ছিল তাইমিয়া, যার সূত্রে তিনি এই উপাধি লাভ করেন। (ভূমিকা, দারউ তাআরুজিল আক্বলি ওয়ান নাক্বলি, ১/৪, আল-মাকতাবাতুত তাওফিক্বিয়্যা, কায়রো, ২০১২)
প্রথম জীবন
তিনি ৬৬১ হিজরি (১২৬৩ খ্রিষ্টাব্দ) বর্তমান তুরস্কের আনাতোলিয়ার হাররান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাতারদের আক্রমণে শহরটি বিধ্বস্ত হলে তিনি পরিবারসহ দামেস্কে আশ্রয় নেন। সেখানেই জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার পথে যাত্রা শুরু করেন।
তাঁর শৈশব থেকেই অসাধারণ প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। হাদিসের পণ্ডিত ইবনে আবদিল হাদি (রহ.) লিখেছেন, ‘তাঁর মেধা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি এত অধিক ছিল যে তা দেখে দামেস্কের অধিবাসীরা অভিভূত হতেন।’ (ভূমিকা, দারউ তাআরুজিল আক্বলি ওয়ান নাক্বলি, ১/৫, আল-মাকতাবাতুত তাওফিক্বিয়্যা, কায়রো, ২০১২)
শৈশবে তিনি কোরআনের প্রতি গভীর আগ্রহ দেখান এবং অল্প বয়সেই হাফেজ হন। এরপর তিনি হাদিস, তাফসির, ফিকহ, আরবি সাহিত্য, দর্শনসহ বিভিন্ন জ্ঞান শাখায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। জ্ঞানার্জন ও শিক্ষকেরা
ইবনে তাইমিয়া তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময় জ্ঞানার্জন ও গবেষণায় নিয়োজিত করেন। তিনি সমকালীন অনেক পণ্ডিতের কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করেন।
আরবি ভাষা ও সাহিত্য: তাঁর শিক্ষক ছিলেন আল্লামা ইবনে আবদুল কাওউই (রহ.), যাঁর কাছ থেকে তিনি এই শাস্ত্রের গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
ফিকহ ও উসুলে ফিকহ: এ বিষয়ে তাঁর পিতা শায়েখ আবদুল হালিম (রহ.) ছিলেন তাঁর প্রধান শিক্ষক।
হাদিস শাস্ত্র: তিনি হাদিসে অসাধারণ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। আল্লামা শামসুদ্দিন জাহাবি (রহ.) বলেন, ‘যে হাদিস ইবনে তাইমিয়া জানেন না, সেটি হাদিসই হতে পারে না।’ (ইবনে ইমাদ হাম্বলি, শাজারাতুজ জাহাব, ৮/১৪৪-১৪৫, দার ইবনে কাসির, বৈরুত, ১৯৯২)
চিন্তাধারা ও মতাদর্শ
ইবনে তাইমিয়া ছিলেন একজন মননশীল, সচেতন ও সংগ্রামী মুসলিম চিন্তাবিদ। তিনি ইসলামি আকিদাকে বিশুদ্ধ রূপে উপস্থাপনের জন্য বিদাত, শিরক ও ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে নির্ভীকভাবে সংগ্রাম করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, জ্ঞান কেবল বই বা পাঠশালার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর উদ্দেশ্য সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে প্রয়োগ। তাঁর মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ছিল:
কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক দলিলের ওপর নির্ভর করে মাজহাবের ইমামদের অনুসরণ।
শরিয়াহভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আইন প্রণয়ন।
সুফিবাদের ভ্রান্ত মতবাদ চিহ্নিতকরণ।
দার্শনিকদের অতিরিক্ত যুক্তিনির্ভর বিভ্রান্তির উন্মোচন। (ভূমিকা, দারউ তাআরুজিল আক্বলি ওয়ান নাক্বলি, ১/৫-৬, আল-মাকতাবাতুত তাওফিক্বিয়্যা, কায়রো, ২০১২)
তাঁর এ চিন্তাধারা কেবল ধর্মীয় ক্ষেত্রেই নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আলেমদের প্রশংসা
ইবনে তাইমিয়ার কিছু মত বিতর্কের জন্ম দিলেও যুগে যুগে অনেক বিদ্বান তাঁর পাণ্ডিত্য ও কৃতিত্বের প্রশংসা করেছেন। হাফেজ মিজ্জি (রহ.) বলেন, ‘কোরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে তাঁর চেয়ে অধিক জ্ঞানী আমি কাউকে দেখিনি।’ (ইবনে ইমাদ হাম্বলি, শাজারাতুজ জাহাব, ৮/১৪৭, দার ইবনে কাসির, বৈরুত, ১৯৯২)
জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) বলেন, ‘তিনি ছিলেন জ্ঞানের মহাসমুদ্র, প্রখর মেধাবী ও একজন খাঁটি আল্লাহপ্রেমী।’ (জালালুদ্দিন সুয়ুতি, তাবাকাতুল হুফফাজ, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা, পৃষ্ঠা: ৫২১, বৈরুত, ১৯৯৪) রচনাবলি
ইবনে তাইমিয়া লেখালেখির ক্ষেত্রে ছিলেন এক কিংবদন্তি। তাঁর রচিত অসংখ্য গ্রন্থ তাঁর চিন্তাধারা ও মতাদর্শের প্রতিফলন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মাজমাউল ফাতাওয়া, যা আজও পাঠকপ্রিয়তায় শীর্ষে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘আস-সারিমুল মাসলুল আলা শাতিমির রাসুল’, ‘মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাভিয়্যাহ’, ‘আল-ইসতিকামা’, ‘আন-নুবুওয়াত’, ‘বায়ানু তালবিসিল জাহমিয়্যা’, ‘দারউ তাআরুজিল আক্বলি ওয়ান নাক্বলি’। (ভূমিকা, দারউ তাআরুজিল আক্বলি ওয়ান নাক্বলি, ১/৭, আল-মাকতাবাতুত তাওফিক্বিয়্যা, কায়রো, ২০১২)
উত্তরসূরি
ইবনে তাইমিয়া শুধু নিজে একজন প্রতিষ্ঠিত আলেমই ছিলেন না; বরং তিনি অনেক মেধাবী ও চিন্তাশীল ছাত্র গড়ে তুলেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ইমাম ইবনুল কায়্যিম আল-জাওজিয়্যাহ, হাফেজ ইবনে কাসির, হাফেজ শামসুদ্দিন জাহাবি, আল-বিকাঈ, ইবনে আবদিল হাদি প্রমুখ। (আসহাবু মু’জামি ইবনে তাইমিয়া, পৃষ্ঠা: ৫৪-১৩৫)
জীবনের সমাপ্তি
৭২৮ হিজরির ২০ জিলকদ (১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দ) দামেস্কের এক কারাগারে ৬৫ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর খবরে পুরো দামেস্ক শোকে নিমজ্জিত হয়। তিনি মাকবারায়ে সুফিয়্যায় সমাধিস্থ হন, যা আজও তাঁর স্মৃতি বহন করে। (ইবনে ইমাদ হাম্বলি, শাজারাতুজ জাহাব, ৮/১৫০, দার ইবনে কাসির, বৈরুত, ১৯৯২)
ইমাম ইবনে তাইমিয়া ছিলেন জ্ঞান, ইমান ও সংগ্রামের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত। তাঁর জীবন ও রচনা মুসলিম উম্মাহর জন্য চিরন্তন প্রেরণা। তাঁর চিন্তাধারা ও আদর্শ আজও মুসলিম বিশ্বে আলো ছড়াচ্ছে এবং তাঁর উত্তরসূরিরা তাঁর জ্ঞানের পতাকা বহন করে চলেছেন।