জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দিনব্যাপী আলোচনায় কোনো ফল আসেনি। গতকাল বৃহস্পতিবার এ আলোচনায় বাস্তবায়নের পদ্ধতি প্রশ্নে যার যার আগের অবস্থানেই অনড় ছিল দলগুলো। আগামী রোববার এ নিয়ে আবার আলোচনা হবে।
এর আগে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেছিল কমিশন। ২৯টি দল লিখিতভাবে তাদের মতামত কমিশনকে পাঠিয়েছিল। বাস্তবায়নের পদ্ধতি প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা প্রকট। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—এই তিন দল তিন ধরনের পদ্ধতির কথা বলেছে।
সংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো আগামী জাতীয় সংসদ গঠনের দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের পক্ষে বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী আগামী নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশের মাধ্যমে বা গণভোটের মাধ্যমে এবং এনসিপি গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন চায়।
বাস্তবায়নের পদ্ধতি প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা প্রকট। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—এই তিন দল তিন ধরনের পদ্ধতির কথা বলেছে।
সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে ৩০টি দলের সঙ্গে একসঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আলোচনা শুরু হয়। মধ্যাহ্নভোজের বিরতি দিয়ে আলোচনা চলে সন্ধ্যা প্রায় ছয়টা পর্যন্ত। এ আলোচনায়ও দল তিনটি আগের অবস্থানে অনড় থেকে নিজ নিজ পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে।
ছয়টি সংস্কার কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই পর্বের আলোচনায় ইতিমধ্যে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। এগুলো নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। সনদের চূড়ান্ত খসড়া গতকাল দলগুলোকে দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। এ সনদে সই করবেন—দলের এমন দুজন নেতার নাম আগামীকাল শনিবারের মধ্যে কমিশনকে জানাতে বলা হয়েছে। তবে কখন সনদ সই হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
বাস্তবায়ন পদ্ধতি ঠিক না হলে সব দল এ সনদে সই করবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। অবশ্য বাস্তবায়ন পদ্ধতি সনদের অংশ হবে না। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সরকারকে সুপারিশ দেবে কমিশন।
জুলাই সনদে যেসব সংস্কার প্রস্তাব আছে, তার মধ্যে বেশ কিছু আছে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব। কিছু বাস্তবায়ন করা যায় নির্বাহী আদেশে। এগুলো অধ্যাদেশ ও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নের বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে। মূল বিতর্ক সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে।
বৈঠকে কমিশন জানায়, জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাবগুলো (ভিন্নমতসহ) চারভাবে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হচ্ছে অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট ও বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ।
আলোচনায় যেসব বিকল্প পদ্ধতি
কোন দল কোন উপায়ে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চায়, তা গতকালের আলোচনার শুরুতে উপস্থাপন করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে কমিশন কী পরামর্শ পেয়েছে, সেগুলোও তুলে ধরা হয়।
সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাব বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে লিখিতভাবে মোটাদাগে ছয়টি সুপারিশ পেয়েছিল কমিশন। সেগুলো হলো পূর্ণাঙ্গ সনদ বা তাঁর কিছু অংশ নিয়ে গণভোট, রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতার বলে বিশেষ সাংবিধানিক আদেশে বাস্তবায়ন, গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন, ত্রয়োদশ সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন, সংসদকে সংবিধান সংস্কার সভা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে সনদের বিষয়গুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে এই মর্মে মতামত চাওয়া যে অন্তর্বর্তী সরকার এই সনদ বাস্তবায়ন করতে পারবে কি না।
বৈঠকে কমিশন জানায়, জুলাই সনদে অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাবগুলো (ভিন্নমতসহ) চারভাবে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হচ্ছে অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট ও বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ।
যদি জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না থাকে, তাহলে আমরা এত দিন এটা কী করলাম? সবকিছু অর্থহীন হয়ে যাবে। সবকিছু বিফলে যাবে। বিপ্লবটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। বিপ্লবকে ধ্বংস করে পুরোনো ধারায় ফিরে যাব? এখানে অনেক ইন্টারেস্ট গ্রুপ তৈরি হবে। রাষ্ট্র বিপদে পড়বে। নির্বাচন ঝুঁকিতে পড়বে।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ
দলগুলো যা বলছে
বিএনপিসহ কিছু দল মনে করে, সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার আগামী সংসদ ছাড়া বাস্তবায়নের কোনো আইনি পথ নেই। দলটির মতে, সাংবিধানিক আদেশ জারি বা গণভোটের মতো প্রস্তাবগুলো অগ্রহণযোগ্য। এখনই এই সনদ কার্যকর হলে দেশে দুটি সংবিধান চলমান থাকবে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বেশ কিছু দল চায় জুলাই সনদের একটি আইনি ভিত্তি এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে এর বাস্তবায়ন।
গতকালের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, সংস্কার আগামী সংসদের হাতে ছেড়ে দিলে গণ-অভ্যুত্থানের প্রতি অবিচার করা হবে। নামমাত্র সংস্কার হলে হবে না। এর আইনি ভিত্তি লাগবে। তার ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, সংস্কার প্রস্তাবগুলোর টেকসই বাস্তবায়নের একমাত্র পথ নতুন সংবিধান। যদি পুরোনো সংবিধানই ঘষামাজা করা হয় এবং এটা বাস্তবায়নে পরবর্তী সরকারের মর্জির ওপর নির্ভর করতে হয়, তাহলে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
বিশেষ সাংবিধানিক আদশ জারির নজির আছে উল্লেখ করে জামায়াতের এই নেতা বলেন, লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের ভিত্তিতে ১৯৭০ সালের নির্বাচন হয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৭ সালেও বিশেষ আদেশ জারি করা হয়েছে। যেটার ভিত্তিতে গণভোট হয়েছে। তিনি বলেন, বিশেষ আদেশের মাধ্যমে সংস্কার বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। গণভোটের মাধ্যমেও হতে পারে। গণভোটের মাধ্যমে হলে সেটা টেকসই হবে।
প্রথমে বিশেষ আদেশের মাধ্যমে এবং পরে প্রয়োজনে গণভোট করা যেতে পারে উল্লেখ করে হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘যদি জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না থাকে, তাহলে আমরা এত দিন এটা কী করলাম? সবকিছু অর্থহীন হয়ে যাবে। সবকিছু বিফলে যাবে। বিপ্লবটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। বিপ্লবকে ধ্বংস করে পুরোনো ধারায় ফিরে যাব? এখানে অনেক ইন্টারেস্ট গ্রুপ তৈরি হবে। রাষ্ট্র বিপদে পড়বে। নির্বাচন ঝুঁকিতে পড়বে।’
এনসিপিও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চায়। তবে তারা ভিন্নভাবে এর বাস্তবায়ন চায়। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় দলের অবস্থান তুলে ধরে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, সংস্কার প্রস্তাবগুলোর টেকসই বাস্তবায়নের একমাত্র পথ নতুন সংবিধান। যদি পুরোনো সংবিধানই ঘষামাজা করা হয় এবং এটা বাস্তবায়নে পরবর্তী সরকারের মর্জির ওপর নির্ভর করতে হয়, তাহলে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
আলোচনার শেষ পর্যায়ে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরে বক্তব্য দেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, যে প্রস্তাবগুলো এসেছে, সাধারণভাবে এগুলো অগ্রহণযোগ্য। দেশে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা আছে। এই ধারাবাহিকতা না থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারসহ সব অবৈধ হয়ে যাবে।
জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির প্রস্তাবের বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, গণপরিষদ হয় নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য। এ ছাড়া সংবিধানের মূল কাঠামো ও চরিত্র পরিবর্তন করতে হলে গণপরিষদ করা হয়। প্রবিশনাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডার হয়েছিল ১৯৭২ সালে, যখন দেশে সংবিধান ছিল না। কিন্তু এখন সংবিধান আছে। জিয়াউর রহমানের আমলে প্রোক্লেমেশন জারির মাধ্যমে সংবিধানে পরিবর্তন আনা হয়নি। তখন সংবিধান স্থগিত ছিল। তাই রাষ্ট্র পরিচালনার স্বার্থে ‘প্রোক্লেমেশন’ (ঘোষণা) জারি করা হয়েছিল। এগুলোর বৈধতা দেওয়া হয়েছিল পরবর্তী সংসদে। প্রোক্লেমেশনের মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তনের এখতিয়ার কারও নেই।
সনদ এখন বাস্তবায়ন করা হলে দুটি সংবিধান চলার মতো অবস্থা হবে। কোনো নাগরিক আদালতে চ্যালেঞ্জ করলে আদালত প্রশ্ন করবেন, সংবিধান কে পরিবর্তন করল, কীভাবে করল, এই এখতিয়ার কারও আছে?
সালাহউদ্দিন আহমদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তাঁদের পরামর্শ হলো, সব দল এখন এই অঙ্গীকারনামায় সই করবে। আগামী সংসদে সংস্কার প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করার জন্য দলগুলো যার যার নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করবে। যারাই সংসদে যাবে, তারা এটার বাস্তবায়ন করবে। জুলাই সনদকে ‘ভায়োলেট’ করে ভবিষ্যতে কোনো দলের রাজনীতি করার সুযোগ আছে বলে তিনি মনে করেন না।
বিএনপির এই নেতা বলেন, সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা কী, এর জবাব তাঁরা দিতে পারবেন না। তাঁরা অঙ্গীকার করতে পারবেন। আর এখন সনদ বাস্তবায়নের কোনো আইনগত ভিত্তি বের করা গেলে বিএনপি তাতে একমত হবে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, তা কি হয়েছে?
এখন বিশেষ আদেশের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন করা হলে যেকোনো নাগরিক আদালতে এটা চ্যালেঞ্জ করতে পারেন বলে মনে করে বিএনপি। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সনদ এখন বাস্তবায়ন করা হলে দুটি সংবিধান চলার মতো অবস্থা হবে। কোনো নাগরিক আদালতে চ্যালেঞ্জ করলে আদালত প্রশ্ন করবেন, সংবিধান কে পরিবর্তন করল, কীভাবে করল, এই এখতিয়ার কারও আছে?
পরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বৈঠকে বলেন, আলোচনা মুলতবি থাকবে। আগামী রোববার বেলা আড়াইটায় আবার আলোচনা শুরু হবে।
দুটি বিষয়ে ঐকমত্য
গতকালের আলোচনা শেষে সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে আলী রীয়াজ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত ভাষ্য আজই পাঠানো হচ্ছে। সনদে সব দলের মতের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। কমিশনের পক্ষ থেকে সনদে স্বাক্ষরের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আগামী শনিবার বিকেল পাঁচটার মধ্যে দুজনের নাম পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গতকালের আলোচনায় দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে বলে জানান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, যেসব বিষয় সংবিধান-সংশ্লিষ্ট নয়, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ জারি করতে পারে। সুপারিশের যেসব বিষয় সরকারি বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আদেশ ও বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেগুলো অন্তর্বর্তী সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করতে পারে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে অধ্যাদেশ জারি ও যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে।
গতকালের আলোচনায় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, মো. আইয়ুব মিয়া এবং ঐকমত্য গঠনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।