ইসলাম মানুষের ভেতরের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক সংগ্রামের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো নফস। কোরআন, হাদিস এবং ইসলামি সাহিত্য নফসকে মানুষের অন্তরের সেই শক্তি বা প্রবৃত্তি হিসেবে বর্ণনা করে, যা একদিকে পাপ ও কামনার দিকে টানে, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণ করলে তাকওয়া ও ইবাদতের দিকে নিয়ে যায়। তাই ইসলামি জীবনদর্শনে নফস একটি মৌলিক ধারণা।
নফসের ভাষাগত অর্থ
আরবি “নফস” শব্দ এসেছে মূল ধাতু “নাফাসা” থেকে, যার অর্থ—প্রাণ, আত্মা, অন্তর, বা ব্যক্তিসত্তা।
লিসানুল আরব অভিধানে বলা হয়েছে: নফস মানে প্রাণ ও সত্তা। (ইবন মানযুর, লিসানুল আরব, খণ্ড ৯, পৃ. ৫৯৯, দারুস সাদির, বৈরুত, ১৯৯০)
ইসলামি পরিভাষায় নফস বলতে বোঝানো হয় মানুষের অন্তরে গেঁথে থাকা সেই প্রবৃত্তিকে, যা কখনো কল্যাণের দিকে, আবার কখনো অকল্যাণের দিকে প্ররোচিত করে। কোরআনে নফস
কোরআনে নফসের বিভিন্ন অবস্থা বর্ণিত হয়েছে।
১. নফসে আম্মারা (পাপপ্রবণ নফস): “নিশ্চয়ই নফস তো মন্দের দিকে প্রবলভাবে প্ররোচিত করে।” (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ৫৩)
এটি হলো নফসের সবচেয়ে নিচু স্তর, যেখানে প্রবৃত্তি কেবল গুনাহের দিকে টানে।
২. নফসে লাওয়ামাহ (ধিক্কারদাতা নফস): “আমি শপথ করি ধিক্কারদাতা নফসের।” (সুরা কিয়ামাহ, আয়াত: ২)
এটি হলো সেই নফস, যা ভুল করলে অনুতপ্ত হয় এবং মানুষকে তওবার দিকে নিয়ে যায়।
৩. নফসে মুতমাইন্নাহ (শান্ত আত্মা): “হে প্রশান্ত আত্মা, তোমার প্রতিপালকের কাছে ফিরে আসো, তুমি তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট, তিনিও তোমার প্রতি সন্তুষ্ট।” (সুরা ফাজর, আয়াত: ২৭-২৮)
এটি হলো নফসের সর্বোচ্চ স্তর, যেখানে আল্লাহর স্মরণে অন্তর প্রশান্ত থাকে।
হাদিসে নফস
রাসুল (সা.) বলেছেন: “সর্বশ্রেষ্ঠ মুজাহিদ সে-ই, যে নিজের নফস ও খেয়ালকে নিয়ন্ত্রণ করে।” (সুনান ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৪২৯৭)
আরেকটি হাদিসে তিনি দোয়া করেছেন: “হে আল্লাহ, আমার নফসকে তাকওয়া দান করো এবং তাকে পবিত্র করো, তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ পবিত্রকারী।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৭২২) আলেমদের দৃষ্টিভঙ্গি
ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেন: “নফস মূলত একটি নিরপেক্ষ শক্তি। এটিকে যদি মানুষ নিয়ন্ত্রণহীন রেখে দেয়, তবে তা পশুর মতো নিচে নেমে যায়। আর যদি তাকওয়া ও শুদ্ধতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত করে, তবে তা ফেরেশতার মতো উচ্চে ওঠে।” (ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন, খণ্ড ৩, পৃ. ৩, দারুল মাআরিফ, কায়রো, ১৯৩৯)
ইবন কাইয়িম জাওযি (রহ.) বলেন: “নফস মানুষের জন্য পরীক্ষার একটি ক্ষেত্র। নফসকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়, সে-ই মুক্তি পায়।” (মাদারিজুস সালিকীন, খণ্ড ১, পৃ. ৩২৭, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যা, বৈরুত, ১৯৯৬)।
জীবনে নফসের প্রাসঙ্গিকতা
আজকের ভোগবাদী যুগে নফসের প্রলোভন আরও তীব্র। ভোগবিলাস, অর্থ ও খ্যাতি মানুষের নফসকে উসকে দেয়। বিজ্ঞাপন ও সোশ্যাল মিডিয়া নফসকে ক্রমাগত প্রলুব্ধ করে। আত্মসংযম ও তাকওয়া ছাড়া নফসকে বশে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
কোরআনে বলা হয়েছে: “যে ব্যক্তি নফসকে পরিশুদ্ধ করে, সে-ই সফল। আর যে একে কলুষিত করে, সে-ই ধ্বংসপ্রাপ্ত।” (সুরা শামস, আয়াত: ৯-১০)
নফস হলো মানুষের অন্তরে লুকিয়ে থাকা প্রবৃত্তি ও সত্তা, যা মানুষের চরিত্র গঠনের মূল চালিকা শক্তি। এটি কখনো আম্মারা হয়ে গুনাহের দিকে টানে, কখনো লাওয়ামাহ হয়ে অনুতপ্ত করে, আবার কখনো মুতমাইন্নাহ হয়ে শান্তির দিকে নিয়ে যায়। ইসলামের শিক্ষা হলো—প্রকৃত মুজাহিদ সেই, যে নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাকওয়ার পথে চালিত করে।