নেপালে রাজনৈতিক অসন্তোষের ব্যাপকতা পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে চমকে দিয়েছে। সমকালীন ইতিহাসে একদিনে রাজনৈতিক কারণে এত মানুষের মৃত্যুর নজির ছিল না এ দেশে। প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। কাঠমান্ডুসহ দেশের অনেক স্থানে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্থাপনা বিক্ষোভের আগুনে পুড়ছে।
প্রাথমিক খবরগুলোয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করাকে তরুণসমাজের অসন্তোষের প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও আসল সমস্যা দেশটির দুর্নীতি ও প্রধান প্রধান দলের প্রবীণ রাজনীতিবিদদের নিয়ে গভীর হতাশা। বিক্ষোভের ব্যাপকতায় ভূরাজনৈতিক উপাদানও যুক্ত আছে বলে অনুমান করছেন স্থানীয় সাংবাদিকেরা।
বিক্ষোভের উৎস দুর্নীতির ব্যাপকতা
বৃহস্পতিবার ছাব্বিশটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করা থেকে সর্বশেষ ঘটনার সূত্রপাত। মূলত এর প্রতিবাদেই কিশোর-তরুণেরা বিক্ষোভে নামেন। কাঠমান্ডুর পাশাপাশি বিক্ষোভ ছড়ায় আরও অনেক শহরে। মানুষ দ্বিতীয় দিনের মতো কারফিউ অগ্রাহ্য করে বিক্ষোভ করছে। সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও কতটা সফল হবে, তা বলা মুশকিল। এ ক্ষেত্রে বিদেশি সাহায্য চাওয়ার সম্ভাবনাও আছে।
তরুণসমাজের আন্দোলনে নামার নৈতিক ও আইনগত যুক্তি হিসেবে ছিল সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদ। যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি রয়েছে। তবে একই অনুচ্ছেদ, বাংলাদেশের মতো এটাও যুক্ত আছে, সরকার সামাজিক শান্তির প্রয়োজনে মতামতের প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। সেই সূত্রেই যোগাযোগমাধ্যমের ওপর চড়াও হয়েছিল সরকার। এর বাইরে গোয়েন্দা বিভাগকে টেলিফোনে আড়ি পাতার অধিকার দিয়ে একটা আইন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে সম্প্রতি। সেটা শহুরে শিক্ষিত সমাজকে অসন্তুষ্ট করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের ঘোষণাকে মিছিল আহ্বানকারীরা শ্রেণিগতভাবে দুইভাবে নিয়েছিল। অনেক নিম্নবিত্ত তরুণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ব্যবসা করেন। তাঁরা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আবার উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানেরাও এতে খেপে যান, কারণ তাঁদের সাংস্কৃতিক অভ্যাসের ছন্দপতন ঘটায় এটা। অনেকের পড়ালেখার ধরনেও সমস্যা বাধে সরকারের সিদ্ধান্তে।
নেপালের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বাংলাদেশের মতোই বিভিন্ন দলের কর্মী-সমর্থকদের রাজনৈতিক কথাবার্তার বড় এক পরিসর। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীরা যদিও শুরুতে বিক্ষোভের সংগঠক ছিলেন না এবং মিছিলেও সংখ্যায় কমই ছিল—কিন্তু সরকারের মিডিয়া নিষিদ্ধের পেছনে দুর্নীতির আলাপ বন্ধের ষড়যন্ত্র দেখছিল তারা।
জ্বলছে নেপালের পার্লামেন্ট ভবন
জ্বলছে নেপালের পার্লামেন্ট ভবনছবি: এক্স (টুইটার)
প্রথমে কম বয়সীদের দিয়ে শুরু হলেও ক্রমে বিক্ষোভে মধ্যবয়সী যুবারাও শামিল হন এবং শেষমেশ এটা অনেকটা সরকারবিরোধী বিক্ষোভের চেহারা নেয় এবং দ্বিতীয় দিন সেটা অনিয়ন্ত্রিত দাবানলের মতো পোড়াচ্ছে নেপালকে। বিক্ষোভের ধরনে প্রধান বিরোধী দলগুলোর বয়োবৃদ্ধ নেতাদের জন্যও গভীর সতর্কবার্তা রয়েছে। ফলে এটা থেকে তাদের ফায়দা নেওয়া এখনই সম্ভব হচ্ছে না।
বিশ্বব্যাপী জেন-জিদের আন্দোলনে যা দেখা যায়, নেপালেও তার ব্যতিক্রম হয়নি—তাৎক্ষণিকভাবে অনেক তারকাশিল্পী বিক্ষোভকারীদের পক্ষ নিয়েছেন। তারকারা বরাবরই পেশাগত স্বার্থে তরুণদের সঙ্গে থাকতে চান। আবার তরুণেরাও তাঁদের প্রিয় তারকার সমর্থন দেখলে বাড়তি চাঙা হন।
নেপালেও সোমবার তা-ই হলো। তবে নিজস্ব ন্যায্য ক্ষোভ বা প্রিয় তারকাদের সমর্থন ও অংশগ্রহণ যে কারণেই হোক বিক্ষোভকারীরা আন্দোলন শুরুর কিছু সময় পরই হঠাৎ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন। ব্যাপক ভাঙচুর শুরু করেন। এ সময় রাষ্ট্রীয় স্থাপনার নিরাপত্তায় নিয়োজিত রক্ষীরা গুলি চালালে তাৎক্ষণিকভাবে মারা গেছেন ১৯ জন। আহত মানুষের সংখ্যাও বিপুল। দ্বিতীয় দিন শেষে পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়াবে, তা কেউ বলতে পারছে না।
রাজনৈতিক অস্থিরতায় নজর রাখছে পরাশক্তিগুলো
কে পি শর্মা অলির নেতৃত্বাধীন চলতি জোট সরকারের জন্য প্রথম দিনের ঘটনাবলি নিশ্চিতভাবে বড় এক ধাক্কা ছিল। পরদিন প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগই করতে হয়। গত বছর জুলাইয়ে অলির নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে অদ্ভুত এক মেরুকরণের মাধ্যমে। অলির দল ইউএমএল (ইউনাইটেড মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী পার্টি) জোট করেছে নেপালি কংগ্রেসের সঙ্গে। অলি নিজে চীনঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
অন্যদিকে নেপালি কংগ্রেসের ঐতিহাসিক ঘনিষ্ঠতা নয়াদিল্লির সঙ্গে। পার্লামেন্টে দলগুলোর আসন-ক্ষমতা এমন যে কেউই সেখানে এককভাবে সরকার গঠন করতে না পারায় অনেকটা ভিন্ন আদর্শের হয়েও অলির সঙ্গে জোট করেছিল নেপালি কংগ্রেস।
২৭৫ আসনের পার্লামেন্টে নেপালি কংগ্রেসের সদস্য আছেন ৮৮ জন, অলির দলের আছেন ৭৬ জন এবং মাওবাদী কেন্দ্রের আছেন ৩২ জন। অলির আগে মাওবাদী প্রচণ্ড একই পার্লামেন্টে ভিন্ন আরেক মেরুকরণে প্রধানমন্ত্রী থেকেছিলেন কিছুদিন।
দেশটিতে ক্ষমতার এ রকম পালাবদলে ভারত ও চীনের ভূমিকা অনেক সময়ই বেশ স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে।
সোমবারের সহিংসতায় ভারত ও চীনের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো না হলেও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাতটি দেশের দূতাবাস একটা বিবৃতি দিয়েছিল। বিবৃতির ভাষায় বিক্ষোভকারীদের দাবির প্রতি সহানুভূতি দেখা গেছে। অলি সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে পুরো বিষয়টা চীনের জন্য একটা আঘাত হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে।
কাঠমান্ডুর কূটনৈতিক পল্লিতে অনেকে নেপালের ঘটনাকে বাংলাদেশের গত বছর আগস্ট অধ্যায়ের সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করতে চাইছেন এবং ভূরাজনীতির যোগ-বিয়োগ মিলাতেও সচেষ্ট এখন।
নেপালের দৈনিকগুলোয় গতকাল খোলামেলাভাবেই লেখা হয়েছে তাদের বিক্ষুব্ধ তরুণেরা বাংলাদেশের গত বছরের আন্দোলন এবং ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের সাম্প্রতিক জনবিক্ষোভ দেখে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ। বলা হচ্ছে, এই তিন দেশের তরুণসমাজের দুর্নীতিবিরোধী আওয়াজ নেপালের জেন-জিকে বিশেষভাবে রাস্তায় নামতে অনুপ্রাণিত করেছে।
নেপালে দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানের বিশেষ খরা চলছে বহুদিন থেকে। এর মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কর্তা ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের আত্মীয়স্বজনের বিলাসী জীবনের ছবি দেখে দেখে মানুষ ক্লান্ত। বেশ কয়েক মাস ধরে রাজনীতিবিদদের পুত্র-কন্যাদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র বিষোদ্গার চলছে। এ রকম বিলাসী সমাজকে ‘নেপো-কিড’ নামে ট্রল করে থাকে নেপালি জেন-জিরা।
প্রভাবশালী পরিবারগুলোর এ রকম ‘নেপো-কিড’দের দুর্নীতির প্রায় প্রতিটি ঘটনায় প্রশাসনের উদাসীনতায়ও জেন-জি ক্ষুব্ধ ছিল। এসবই এই বিক্ষোভের সামাজিক প্রধান জ্বালানি ছিল। তবে বিক্ষোভের পেছনে আরেকটি ভূরাজনৈতিক যোগসূত্র থাকতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। নেপালের দাবি করা একটা সীমান্ত অঞ্চলে ভারত ও চীন যৌথ ‘বর্ডার হাট’ করতে চাওয়ায় সাধারণ নেপালিরা দুই সপ্তাহ ধরে ব্যাপক ক্ষুব্ধ।
সড়ক অবরোধ করে থাকা বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে নেপালি এক সেনা হাত জোড় করে আছেন। কাঠমান্ডু, নেপাল, ৯ সেপ্টেম্বর
সড়ক অবরোধ করে থাকা বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে নেপালি এক সেনা হাত জোড় করে আছেন। কাঠমান্ডু, নেপাল, ৯ সেপ্টেম্বরএএফপি
কালাপানি নামের এই এলাকাটি যদিও ভারতের দখলে এবং তারা চীনের সঙ্গে সেখানকার লিপুলেখ এলাকায় বাজার বসাতে চাইছে এখন—কিন্তু নেপালিরা মনে করে এই অঞ্চল আগে তাদেরই ছিল। ২০১৯ থেকে ভারত এটা তাদের মানচিত্রে দেখাচ্ছে এবং চীন সেটা মেনে নিচ্ছে। সাধারণ নেপালিরা চাইছিল তাদের সরকার শক্তভাবে এই দাবিতে ভারত ও চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়াক।
কিন্তু বর্তমান জোট সরকারের প্রধান দল নেপালি কংগ্রেস ভারতপন্থী এবং দ্বিতীয় শরিক ইউএমএল চীনপন্থী হওয়ায় এ নিয়ে খুব বেশি প্রতিবাদ ওঠেনি। অন্যান্য প্রধান বিরোধী দলও সম্ভবত এ বিষয়ে ভারতকে বেশি চটাতে চাইছিল না। নেপালে অতীতেও এ রকম হয়েছে—প্রথম সারির রাজনীতিবিদেরা বিদেশি বন্ধুদের খুশি রাখতে গিয়ে দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার দায় এড়িয়ে গেছেন।
আবার যে ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে সরকার আয়কর না দেওয়া এবং নথিভুক্ত না হওয়ার দায়ে নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল, তারাও এই বিক্ষোভের পরোক্ষ ইন্ধনদাতা হিসেবে আছে। নিষিদ্ধের মাধ্যমে তাদের বিপুল মুনাফার বাজার হারানোর অবস্থা তৈরি হয়েছিল। তারাও চাইছিল শক্ত ধাঁচের এক দফা বিক্ষোভ হোক।
বিক্ষোভকারীদের কয়েকজন সংগঠক বলছেন, পার্লামেন্টে আক্রমণের কোনো লক্ষ্য ছিল না তাদের। কিছু গোষ্ঠী জমায়েতকে ব্যবহার করে ভাঙচুরের ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। দ্বিতীয় দিন থেকে পরিস্থিতিতে তাদের আর নিয়ন্ত্রণ নেই।
জনজীবন এবং রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা
প্রথম দিনের বিক্ষোভ শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক পদত্যাগ করেছিলেন। পদত্যাগকালে তিনি বলেন, রক্তপাতের নৈতিক দায় তার। কিন্তু মঙ্গলবার সকাল থেকে মানুষের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির পদত্যাগের দাবিও বেশ সমর্থন পেতে শুরু করে। তৃতীয় প্রধান দল ‘মাওবাদী কেন্দ্র’ এ বিষয়ে বিশেষ উৎসাহী ছিল। এখন অলি পদত্যাগের পর নতুন সরকার—নাকি নতুন নির্বাচন হবে, সেটা অস্পষ্ট। কারণ, রাজধানীতে স্পষ্টত এখন কারও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নেই।
সাধারণ মানুষ মনে করছে, বিক্ষোভ দমনে সরকার অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে। কেউ কেউ সরকারকে শিশু হত্যাকারী বলেও উল্লেখ করছিল। পদত্যাগকারী প্রধানমন্ত্রী অলির জন্য একটা সুবিধার দিক ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর দলের ছিলেন না। যেহেতু দেশটিতে জোট সরকার চলছে, সেই সূত্রে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন নেপালি কংগ্রেস থেকে। তবে দ্বিতীয় দিন অলি দায় এড়ানোর সব সুবিধার বাইরে চলে গেছেন। পদত্যাগের মধ্য দিয়ে দলে হয়তো তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্বই বিপন্ন হলো।
বয়স ৭৪ বছর বয়স হওয়ায় গত সপ্তাহ পর্যন্ত অলিকে অবসরে যাওয়ার জন্য চাপে রেখেছিলেন দলীয় তরুণেরা। এখন হত্যাকাণ্ডের ও পদত্যাগের পর নিশ্চিতভাবে দলের ভেতর থেকে নতুন করে তাঁকে সরে যাওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হবে।
বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট কমপ্লেক্সে আগুন দেন। পেছনে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। এর মধ্যে পার্লামেন্ট কমপ্লেক্সের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে একজন বিক্ষোভকারী। কাঠমান্ডু, নেপাল, ৯ সেপ্টেম্বর
বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট কমপ্লেক্সে আগুন দেন। পেছনে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। এর মধ্যে পার্লামেন্ট কমপ্লেক্সের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে একজন বিক্ষোভকারী। কাঠমান্ডু, নেপাল, ৯ সেপ্টেম্বররয়টার্স
ইউএমএলেতে নিয়ম ছিল বয়স ৭৪ হলে এবং পরপর দুবার কোনো পদে থাকলে তাঁকে সরে দাঁড়াতে হবে। অলি সেটা মানতে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং চলতি বিক্ষোভের আগের দিনই তাঁর প্রভাবে দলের একটা কমিটি এই নিয়ম পাল্টানোর ঘোষণা দেয়। মূলত পুনরায় দলের চেয়ারম্যান হতে তাঁকে পথ করে দিতেই দলীয় নিয়ম পাল্টানো হয়।
এসব ঘটনাও নেপালজুড়ে বিরক্তি তৈরি করেছে। সবাই ভাবছে প্রবীণেরা কোনোভাবেই জায়গা ছাড়তে ইচ্ছুক নন। এখন মনে হচ্ছে তরুণেরা নিজেরাই রাজনীতিবিদদের তাড়াতে নেমেছেন।
প্রধানমন্ত্রী সোমবারের সহিংসতার পরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিষেধাজ্ঞা সরাননি। তবে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। তাঁর পদত্যাগে সেটা সহজ হলো। সরকারের অংশীদার নেপালি কংগ্রেসও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি তুলেছে। এই দলের প্রভাবশালী নেতা শেখর কৈরালা সরকার থেকে কংগ্রেসকে বেরিয়ে আসারও আহ্বান জানিয়েছেন।
দলটির সম্পাদক গগন কুমার থাপা বলেছেন, রক্তপাতের দায় প্রধানমন্ত্রীরও। অলির ছোঁয়া থেকে সবাই এখন দূরে সরতে চাইছেন। বিরোধী দলগুলো বেশি চাপ প্রয়োগ করতে পারলে শিগগিরই হয়তো আগাম নির্বাচন আদায় করতে পারবে। যদিও স্বাভাবিক নিয়মে পরবর্তী পার্লামেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা আগামী বছর। সোমবারের রক্তপাতের পরই সবার আগে নির্বাচন চেয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি। তারা পার্লামেন্টে চতুর্থ বড় দল। বর্তমান বাস্তবতায় নির্বাচন হলে তরুণদের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা দলগুলো বাড়তি ভোট পেতে পারে। অন্তত শহরাঞ্চলে।
তবে নির্বাচন হলে বিশেষভাবে লাভবান হবে রাজতন্ত্রপন্থী দল—যাদের নাম আবার ‘প্রজাতন্ত্রী পার্টি’। শেষোক্ত এই দলও চলতি সামাজিক অসন্তোষকে নির্বাচন পর্যন্ত গড়িয়ে নিতে ইচ্ছুক। তারা কংগ্রেস, ইউএমএলের পাশাপাশি বিরোধী দল মাওবাদীদেরও বিরোধী।
রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী নাগরিক সমাজের অনেক প্রভাবশালীও জেন-জিদের চলতি আন্দোলনে বেশ উৎসাহ দেখাচ্ছে। এর মধ্যে আছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী দুর্গা প্রসাই। দুর্গা এবং সাবেক রাজা জ্ঞানেন্দ্রের নাতি হিরেন্দ্র শাহ জেন-জি বিক্ষোভে শামিল হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জেন-জিরা তাদের আসতে নিষেধ করেন। অনেকের সন্দেহ দ্বিতীয় দিনের সহিংসতায় তাদের হাত আছে।
২০০৮ সালে রাজার হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার পর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রধান দলগুলো প্রায় সবাই একাধিকবার করে সরকারে নেতৃত্ব দিয়েও দেশটির জনজীবনে অর্থনৈতিক অবস্থায় উল্লেখযোগ্য বদল ঘটাতে পারেনি। ফলে রাজতন্ত্রীদের প্রতি জনসমাজে একরূপ পক্ষপাতও বাড়ছে।
মাওবাদী কেন্দ্রের প্রচণ্ড এবং অপর মার্ক্সবাদী নেতা কে পি শর্মা অলি ইতিমধ্যে তিনবার করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। নেপালি কংগ্রেসের শের বাহাদুর দিউবা এ পর্যন্ত পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বলা হয়, নেপাল এই তিন নেতার হাতে বন্দী। ঘুরেফিরে তাঁরাই প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, কিন্তু দেশটির ভাগ্যের বদল ঘটছে না। মূলত এই হতাশা থেকেই নেপালে ৮ সেপ্টেম্বরের রক্তপাত এবং পরের দিনের সহিংসতা হলো।
এসব ঘটনায় দেশটির প্রশাসনিক কাঠামো পুরো ভেঙে না পড়লেও আমূল এক ঝাঁকুনি খেল। এতে করে দেশটির রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে জেন-জির অভিষেক ঘটল। ভবিষ্যতের ভোটের রাজনীতিতে এর প্রভাব হতে পারে বিপুল—যার পুরোটা এখনই অনুমান করা যাচ্ছে না।
তবে নেপালের তরুণেরা স্পষ্টত কোনো দলের প্রবীণ রাজনীতিবিদদের আর দেখতে চাইছেন না। তাঁরা মনে করছেন, তাঁরা নেপালে আর্থসামাজিক রূপান্তর ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু তরুণেরা একই সঙ্গে দেশটিকে গভীর এক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায়ও ফেলেছেন।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক
* মতামত লেখকের নিজস্ব