শিক্ষক শব্দটা বেশ ভারী। পুরুষ শিক্ষকদের একসময় বলা হতো মাস্টার। নারী শিক্ষক ছিলেন মাস্টারনি। এখন এসব সম্বোধন কেতাব থেকে প্রায় উঠে গেছে।
শিক্ষকের কাজ ছাত্র পড়ানো। স্কুলে শিক্ষকেরা একসময় বইপত্র পড়াতে মুষ্ট্যাঘাত আর বেত্রাঘাত চালাতেন সমানতালে। শিক্ষকেরা পণ্ডিত নামে পরিচিত ছিলেন। তখন সম্পর্কটা ছিল গুরু-শিষ্যের। এ নিয়ে একটা কৌতুক আছে। অভিভাবক ছেলেকে টোলে ভর্তি করাতে এসে পণ্ডিতকে বলছেন, ‘ছেলেকে আপনার কাছে রেখে গেলাম। মাংস আপনার, হাড্ডি আমার।’ এর অর্থ হলো পিটিয়ে-পাটিয়ে ছেলেকে মানুষ করে দেবেন। হাড্ডি না ভাঙলেই হলো। পরিশ্রমী গবেষক আবদুল করিম প্রাচীন পুঁথি ঘেঁটে সারদামঙ্গল থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি তুলে এনেছেন:
শিখিতে না পারে তবু শিখাইতে না ছাড়ে
মারিয়া বেতের বাড়িএ ঠেঙ্গা করে।
কভু কভু বান্ধ্যা রাখে বুকে বসে রয়
উচিত করএ শাস্তি যেদিন যে হয়।
এখন ছাত্রদের আর ছাত্র বলা যায় না। ইউনিসেফ শিখিয়ে দিয়েছে, তারা হলো শিশু। তাদের গায়ে হাত কিংবা বেত লাগলে শিশু অধিকার ক্ষুণ্ন হয়, মানবাধিকারে আঘাত লাগে। এ নিয়ে অভিভাবক মামলা করতে পারেন। শিক্ষকেরা এখন অনেক সতর্ক।
মাঝেমধ্যে খবর শুনি, শিক্ষকের দায়িত্ব ছাত্ররা নিয়ে নিয়েছে। শিক্ষক কথা না শুনলে ছাত্ররা তাঁদের ধরে পেটায়। কখনো-সখনো ছাত্রের অভিভাবক শিক্ষককে ডেকে এনে ভর্ৎসনা করেন, চড়–থাপ্পড় দেন, কান ধরে ওঠবস করান, এমনকি মেরে হাড়গোড়ও ভেঙে দেন।
একসময় শিশুরা গায়ে-গতরে বড় হয়, বিদ্যাবুদ্ধি বাড়ে। স্কুল-কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সেই সঙ্গে তাদের শৈশব চলে যায়। ডাঙর হওয়ার পর তাদের অনেকের অবস্থা হয় টোলের পণ্ডিতে মতো। তারা সবার ওপর ছড়ি ঘোরায়, এমনকি শিক্ষকের ওপরও। হাল আমলে নাকি শিক্ষকেরা চাকরি ও প্রমোশন পাওয়ার জন্য ছাত্রনেতাদের দরজায় ধরনা দেন। ছাত্রদের সুপারিশে হলের প্রভোস্ট কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রোভিসি হন। আজকাল এ রকম সংবাদ প্রায়ই চোখে পড়ে, উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ছাত্ররা উপাচার্যের অফিস ঘেরাও করে রেখেছে। এক দিন-দুই দিন যায়। পড়াশোনা লাটে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন অচল হয়ে পড়ে। তারপর সরকার বাহাদুর সিদ্ধান্ত নেন। কপাল ভালো থাকলে উপাচার্যের অন্য কোথাও বদলি। যাঁর কপাল মন্দ, তিনি চাকরি হারান।
জুলাই আন্দোলন দমাতে যারা শক্তি প্রয়োগ করেছে, গুলি করে মানুষ মেরেছে, তাদের মাতবরগুলো ইতিমধ্যে পগারপার। যেগুলো রয়ে গেছে, তাদের বিরুদ্ধে দেদার রুজু হচ্ছে হত্যা মামলা। সেখানে শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে আসামি। তালিকার বাইরেও আছে অনেকেই। তাদের নাম হচ্ছে ‘অজ্ঞাতনামা’। শুনতে পাই, মামলায় আসামির তালিকায় পুলিশের সঙ্গে মিলে-ঝুলে নামগুলো ঢুকিয়েছে চিহ্নিত কিছু রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা আর উকিলেরা। ‘যদি টাকা দাও, তাহলে তালিকা থেকে নাম বাদ দেব।’ এ নিয়ে হচ্ছে অবাধ বাণিজ্য। আচ্ছা, একটা লোককে মারতে কি এক হাজার লোক লাগে?
আমি ভাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ভার ছাত্রদের ওপর ছেড়ে দিলে কেমন হয়? ছাত্রদের দ্বারা নির্বাচিত উপাচার্য। ছাত্রদের পছন্দেই যদি নিয়োগ দিতে হয়ে, তাহলে সরাসরি নির্বাচন দিলে মন্দ হয় না! এই যেমন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়। সেখানে সহসভাপতিসহ অন্যান্য পদে সরাসরি নির্বাচন হয় গোপন ব্যালটে।
পদাধিকারবলে উপাচার্য হলেন ছাত্র সংসদের সভাপতি। তো তাঁকেও তো ছাত্ররা নির্বাচিত করতে পারে। উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি যখন ছাত্ররা করতে পারে, তাঁকে নির্বাচিত হয়ে আসার দাবিও তো করা যায়। তাহলে তো আর কথায় কথায় পদত্যাগের দাবি তুলতে হয় না।
একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় চালানোর খরচপাতিও ছাত্ররা জোগাড় করতে পারে। একটা দৃশ্য কল্পনা করুন: ছাত্ররা তাদের টাকায় তাদের দ্বারা নির্বাচিত উপাচার্য-প্রভোস্ট দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছে। ব্যাপারটার মধ্যে গণতন্ত্র আছে, স্বায়ত্তশাসনও আছে। এ রকম হলে সরকারের ‘হস্তক্ষেপের’ নালিশ উঠবে না। এই যে এখন নাগরিকেরা ট্যাক্সের মাধ্যমে টাকার জোগান দেয়, সরকার উপাচার্য নিয়োগ দেয় আর ছাত্রদের কথায় উপাচার্যকে চলতে হয়, এ কেমন ব্যবস্থা? এ রকম তো চলতে পারে না? হয় উপাচার্যের কথা ছাত্রদের শুনতে হবে, না হয় বিশ্ববিদ্যালয়কে পুরোপুরি স্বাধীনতা দিয়ে দিতে হবে। তখন ছাত্ররাই সব চালাবে। স্বাধীন-সার্বভৌম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের রাস্তা দিয়ে তারা ‘বহিরাগতদের’ ঢুকতে দেবে না। এখনো কেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও স্বাধীনতা ঘোষণা করল না?
টেলিভিশনে যা দেখি, খবরের কাগজে যা পড়ি আর পাড়ার চায়ের দোকানে যা শুনি, তাতে মাথা ঠিক রাখা যায় না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা এমন কেন? গরিব মানুষ হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে খাজনা দিয়ে সরকার চালায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য টাকা ঢালে, তাদের টাকায় ছাত্রাবাস হয়। সেখানে ছাত্ররা রাখবে বই-খাতা-কলম-কম্পিউটার। তা নয়, পুলিশ মাঝেমধ্যে সেখানে চিরুনি অভিযান চালিয়ে লাঠি, চাপাতি, রামদা, বন্দুক আর বুলেটের দেখা পায়।
ছাত্ররা একবার বই ছেড়ে পথে বের হলে তাদের সবার পক্ষে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাদের মোটাদাগে দুই ভাগ করা যায়। এক ভাগ নিয়মিত পড়াশোনা করে চাকরি–বাকরি করতে চায়। কারণ, তাদের বাপ-দাদার জমিদারি নেই, চুরিচামারিও জানে না। আরেক ভাগ ঘোরে নানান ফিকিরে। একবার নরমাংসের স্বাদ পেলে বাঘ যেমন ভয়ংকর হয়ে ওঠে, তাদের অবস্থাও ওই রকম। ‘আন্দোলন’ করে তারা অনেকেই দেশোদ্ধার করেছে। এখন তাদের মাথায় নিয়ে নাচতে হবে। তাদের দোকানপাটের দখল বুঝিয়ে দিতে হবে। নিয়মিত চাঁদা দিতে হবে।
এ দেশ তো আন্দোলনের দেশ। কয়েক বছর পরপরই আন্দোলন হয়। যারা আন্দোলন করে তারা বলে, তাদের আন্দোলনই নাকি দেশের সেরা আন্দোলন। আগেরগুলো নাকি কিছুই না। দখলি বন্দোবস্ত কায়েমের জন্য এর চেয়ে বড় ছুতো আর কী হতে পারে। ১৯৭১ সাল থেকেই দেখে আসছি দখলদারদের রাজত্ব। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে হঠাৎ গজিয়ে উঠেছিল ষোড়শ বাহিনী। তারা রাতারাতি হয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি-গাড়ি-দোকান-চাকরি দখল করে তারা গ্যাঁট হয়ে বসে গেল। বাগিয়ে নিল মুক্তিযোদ্ধার সনদ। আহা, কী আরাম! মাসে মাসে ২০ হাজার টাকা সেলামি। সেই সঙ্গে উৎসব ভাতা এবং আরও কত–কী সুবিধা!
২০২৪-এর ৫ আগস্টের পরও দেশে অনেক নব্য সমন্বয়কের উদয় হলো। সেই একই স্টাইল। তাদের বিরুদ্ধেও সেই একই চাঁদা, দখল আর হম্বিতম্বির অভিযোগ। শুনতে পাই, কোথাও কোথাও তাদের পরিবারের লোকজনও নেমে গেছেন দখলবাণিজ্যে।
এখন কত রকমের দাবিদাওয়া। এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। দাবি তোলার জন্য মোক্ষম জায়গা হচ্ছে শাহবাগের মোড়। সেখানে বসে ঘণ্টাখানেক চিল্লাচিল্লি করলেই গাড়িঘোড়া সব থেমে যায়। শহর স্থবির হয়ে পড়ে। অতএব দাবি মেনে নাও। দাবি মানতে তো সরকারের অসুবিধা নেই। টাকাটা কারও বাবার পকেট থেকে আসে না। আসে গরিব মানুষের ট্যাক্স থেকে।
এদিকে হয়েছে আরেক ফ্যাসাদ। জুলাই আন্দোলন দমাতে যারা শক্তি প্রয়োগ করেছে, গুলি করে মানুষ মেরেছে, তাদের মাতবরগুলো ইতিমধ্যে পগারপার। যেগুলো রয়ে গেছে, তাদের বিরুদ্ধে দেদার রুজু হচ্ছে হত্যা মামলা। সেখানে শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে আসামি। তালিকার বাইরেও আছে অনেকেই। তাদের নাম হচ্ছে ‘অজ্ঞাতনামা’। শুনতে পাই, মামলায় আসামির তালিকায় পুলিশের সঙ্গে মিলে-ঝুলে নামগুলো ঢুকিয়েছে চিহ্নিত কিছু রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা আর উকিলেরা। ‘যদি টাকা দাও, তাহলে তালিকা থেকে নাম বাদ দেব।’ এ নিয়ে হচ্ছে অবাধ বাণিজ্য। আচ্ছা, একটা লোককে মারতে কি এক হাজার লোক লাগে?
এদিকে শুনি, হত্যা মামলা দিলে নাকি জামিন হয় না। আমরা জানি, এ দেশের আদালতে জামিন-বাণিজ্য করে অনেক বটতলার উকিল আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। সবাই ভাগাভাগি করে খায়। একধরনের সমাজতন্ত্র।
ছাত্রদের মধ্যে অধৈর্য দেখা যাচ্ছে। তারা এখন আর তাদের প্রতিষ্ঠানের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থাকতে চায় না। প্রায়ই আশপাশের গ্রামে বা রাস্তায় ঢুকে পড়ে। সেখানে হাতাহাতি-কিলাকিলি হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে মাতম হয়। ছাত্রদের ওপর হাত তোলে? কত বড় আস্পর্ধা!
মন খুলে গাইতে ইচ্ছা করে, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব