মানুষের প্রতিদিনের জীবন নানা বিপদ, দুঃশ্চিন্তা, শয়তানের প্ররোচনা এবং দুনিয়ার পরীক্ষায় ঘেরা। ইসলাম আমাদের শিখিয়েছে দিনের শুরু ও শেষটা যেন আল্লাহর স্মরণে হয়। এজন্য রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট আমল, যেগুলো সকাল-সন্ধ্যায় পড়া সুন্নাত এবং জীবনকে করে তোলে বরকতময়, প্রশান্ত ও নিরাপদ।
সকাল-সন্ধ্যায় আমলের গুরুত্ব
কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, “তুমি তোমার রবের নাম সকাল-সন্ধ্যায় স্মরণ করো।” (সুরা দাহ্র, আয়াত: ২৫)
আবার বলেন, “সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা কর।” (সুরা রুম, আয়াত: ১৭)
এ থেকে বোঝা যায়, প্রতিদিন ভোর থেকে সূর্য ওঠা পর্যন্ত এবং বিকেল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহর জিকির করা মু’মিন জীবনের অপরিহার্য অংশ।
সকাল-সন্ধ্যার কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল
মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবিদের সকাল-সন্ধ্যার আমল শিখাতেন নিয়মিত।
১. আয়াতুল কুরসি পাঠ: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় আয়াতুল কুরসি পড়বে, সে আল্লাহর হেফাজতে থাকবে।” (সুনানে নাসায়ি, হাদিস: ১০০৪)
২. সুরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়া: প্রতিটি তিনবার করে পাঠ করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ণ নিরাপত্তা পাওয়া যায়। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫০১৭)
৩. ‘সায়্যিদুল ইস্তিগফার’ পাঠ: “আল্লাহুম্মা আনতা রব্বি… (যাকে সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার বলে)” যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় পাঠ করবে, সে জান্নাত লাভ করবে ইনশাআল্লাহ। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩২৩)
সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার হলো: আল্লাহুম্মা আনতা রব্বি, লা ইলাহা ইল্লা আনতা, খালাকতানি, ওয়ানা আবদুক, ওয়ানা আ’লা আহদিকা ওয়াওয়াদিকা মাসতাতাতু, আউযু বিকা মিন শার্রি মা সানাতু, আবূউ লাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়া, ওয়াবূউ লাকা বিজাম্বি, ফাগফিরলি, ফাইন্নাহু লা ইয়াগফিরুয্ যুনুবা ইল্লা আনতা।
অর্থ: হে আল্লাহ, আপনি আমার প্রতিপালক, আপনি ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত আর কেউ নেই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আমি আপনার বান্দা। আমি যথাসাধ্য আপনার অঙ্গীকার ও ওয়াদা পালন করি। আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে। আমি আপনার অনুগ্রহ স্বীকার করি এবং আমার গুনাহ স্বীকার করি। অতএব আমাকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই আপনার ছাড়া আর কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না।
৪. সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি (১০০ বার): মহানবী (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি সকালে ও সন্ধ্যায় ‘সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি’ (আল্লাহ পবিত্র, আর সমস্ত প্রশংসা তাঁর জন্য) ১০০ বার পড়বে, সে কেয়ামতের দিন সবচেয়ে উত্তম আমলকারী হবে।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৯২)
৫. আল্লাহর কাছে হেফাজতের দোয়া: হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি ‘আউযু বিকালিমাতিল্লাহিত-তাম্মাতি’—এই দোয়া সন্ধ্যায় পড়বে, তাকে রাতে কোনো ক্ষতি করবে না।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৭০৮)
উচ্চারণ: আউযু বিকালিমাতিল্লাহিত-তাম্মাতি মিন শার্রি মা খালাক।
অর্থ: আমি আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ কালিমার আশ্রয় চাই, তাঁর সৃষ্টির অনিষ্ট থেকে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৭০৮)
৬. বিসমিল্লাহিল্লাযি লা ইয়াদুররু… (৩ বার): তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি সকালে ও সন্ধ্যায় ‘বিসমিল্লাহিল্লাযি লা ইয়াদুররু’—দোয়া তিনবার পড়বে, তাকে কোনো বিপদ স্পর্শ করবে না।” (সুনান তিরমিজি, হাদিস: ৩৩৮৮)
উচ্চারণ: বিসমিল্লাহিল্লাযি লা ইয়াদুররু মা’আসমিহি শাইউন ফিল আরদি ওয়ালা ফিসসামা, ওয়াহুয়াস সামিউল আলিম।
অর্থ: আল্লাহর নামে, যার নামে পৃথিবী বা আসমানে কোনো কিছুরই ক্ষতি করতে পারবে না। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।
৭. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু…: এই দোয়াটিও ১০ বার বা ১০০ বার পড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৯১)
উচ্চারণ: লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহ, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদ, ওয়াহুয়া ‘আলা কুল্লি শাইইন কাদির।
অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনি একক, তাঁর কোনো শরিক নেই। সার্বভৌমত্ব তাঁর, প্রশংসা তাঁর, আর তিনি সব কিছুর ওপর সর্বশক্তিমান।
সকাল-সন্ধ্যার আমলের লাভ
ব্যস্ত জীবনে মানসিক প্রশান্তি আনে : প্রতিদিনের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হতে সকাল-সন্ধ্যায় কয়েক মিনিটের এ দোয়া মনকে শান্ত করে।
অদৃশ্য সুরক্ষা দেয় : রাসুল (সা.)-এর বর্ণিত দোয়াগুলো শয়তান, জিন, ও অনিষ্ট থেকে নিরাপদ রাখে।
সন্তান ও পরিবারকে হেফাজত করে : শুধু নিজে পড়া নয়, বরং পরিবারকে এ আমল শিক্ষা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করে : নিয়মিত আমলকারীর ঈমান মজবুত হয় এবং তার দিন শুরু হয় বরকতে।
সকাল-সন্ধ্যার আমল হলো আল্লাহর স্মরণে দিন শুরু ও শেষ করার একটি মহান সুযোগ। এগুলো শুধু কিছু শব্দ বা দোয়া নয়, বরং আল্লাহর দেওয়া অদৃশ্য ঢাল, যা মুমিনকে রক্ষা করে বিপদ ও গুনাহ থেকে। তাই প্রতিটি মুসলিমের উচিত এ আমলগুলো শিখে নেওয়া, নিয়মিত পাঠ করা এবং পরিবার-পরিজনকে শিক্ষা দেওয়া।