বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে রোববার সন্ধ্যার পৃথক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে আবারও তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। জুলাই সনদ ও নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত ও সহিংসতা এবং নির্বাচন নিয়ে একধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টা এই দলগুলোকে বৈঠকে ডেকেছিলেন। আজ তিনি আরও সাতটি দলের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন।
গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের বার্ষিকীতে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রোজার আগে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এরপর ২৮ আগস্ট নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবে, এটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতার কারণে তা এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়; বরং হঠাৎ করেই রাজনীতিতে যে উত্তেজনা ও সহিংসতা দেখা গেল, তাতে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তার মাত্রাও বৃদ্ধি পায়।
গত সপ্তাহে ঢাকার কাকরাইলে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে গণ অধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীদের সংঘাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাঠিপেটায় নুরুল হকসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি ওঠে এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় দলটির কার্যালয়ে ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে, আহত হন দুই শতাধিক শিক্ষার্থী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও হঠাৎ সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এসব সংঘাত ও অস্থিরতা ঘোষিত সময়ে নির্বাচন হতে পারবে কি না, তা নিয়ে জনমনে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তৈরি হয়।
সংঘাত ও অনিশ্চয়তার এই পরিবেশের মধ্যে সরকারের দিক থেকে যে দৃশ্যমান রাজনৈতিক উদ্যোগ, সেটা ইতিবাচক। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গতকাল সৌজন্য সাক্ষাৎকালে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান আইনশৃঙ্খলা উন্নয়নে সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রোববারের বৈঠকে তিনটি দল তিন ধরনের অবস্থান তুলে ধরেছে। দেখা যাচ্ছে নির্বাচন ও জুলাই সনদ প্রশ্নে এই
তিনটি রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিভিন্ন বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক। মতপার্থক্য কাটিয়ে মতৈক্যে পৌঁছানোর সবচেয়ে সেরা উপায় হলো আলাপ-আলোচনা। প্রধান উপদেষ্টাও সংস্কার ও নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় ও আলোচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণযাত্রায় দ্রুত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। আমরা মনে করি, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, জননিরাপত্তা—সব বিবেচনায় ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ঘোষিত সময়ের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা খুব স্পষ্টভাবে সতর্ক করে বলেছেন যে কেউ যদি নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নিয়ে ভাবে, সেটা হবে জাতির জন্য গভীর বিপজ্জনক। আমরা আশা করব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের স্বার্থে নিজেদের মধ্যকার মতভিন্নতা কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে।
এই মুহূর্তে নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টিতে বড় বাধা হলো দেশের ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। পুলিশের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা করব, অন্তর্বর্তী সরকার, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ—সব পক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগ ও সহযোগিতায় ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে দেশে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দীর্ঘদিন ভোটাধিকারবঞ্চিত জনগণ নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।