ইহসান ইসলামের একটি মৌলিক ধারণা, যা মানুষের সঙ্গে আল্লাহ মহানের সম্পর্ককে সর্বোচ্চ মর্যাদায় নিয়ে যায়। রাসুল (সা.) ইহসানের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে: “ইহসান হলো তুমি এমনভাবে মহান আল্লাহর ইবাদত করবে, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। আর যদি তুমি তাঁকে দেখতে না পাও, তবে তিনি তোমাকে দেখছেন।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫০)
ইহসান যখন একজন মুমিনের জীবনে প্রতিফলিত হয়, তখন তা তার নিজের সঙ্গে, অন্যদের সঙ্গে এবং চারপাশের সৃষ্টির সঙ্গে তার আচরণে প্রকাশ পায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ে ইহসানের নির্দেশ দিয়েছেন।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৫৫)
এই নির্দেশ কোরআনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সঙ্গে তুলনীয়, যেমন আল্লাহ নিজের ওপর রহমতকে অপরিহার্য করেছেন (সুরা আনআম, আয়াত: ১২) এবং তিনি ও তাঁর রাসুলদের বিজয়ের নিশ্চয়তা দিয়েছেন (সুরা মুজাদালা, আয়াত: ২১)।
ইহসান হলো তুমি এমনভাবে মহান আল্লাহর ইবাদত করবে, যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। আর যদি তুমি তাঁকে দেখতে না পাও, তবে তিনি তোমাকে দেখছেন।
সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫০
এই প্রবন্ধে আমরা ‘ইহসান’র ৫টি ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করব।
১. মহান আল্লাহর সঙ্গে ইহসান
ইহসানের প্রথম ধাপ হলো আল্লাহর সঙ্গে ইহসান। এর মানে হলো, আমরা সবসময় মনে রাখব যে আল্লাহ মহান আমাদের দেখছেন। এই চেতনা আমাদের নিজেদের, আমাদের সন্তানদের এবং যাদের সঙ্গে কথা বলি, তাদের মনে জাগিয়ে তুলতে হবে। যখন ভয়, একাকীত্ব বা উদ্বেগ আমাদের ঘিরে ধরে, তখন আমাদের মনে রাখতে হবে যে আল্লাহ আমাদের দুর্বলতা ও প্রয়োজন দেখছেন। তিনি আমাদের সাহায্য পাঠাবেন, কারণ তাঁর বান্দাদের কথা কেবল তিনিই জানেন। তাঁর রহমত সবকিছুকে ঘিরে আছে এবং তিনি সবকিছু সম্পর্কে জানেন। (সুরা মুমিন, আয়াত: ৭)
আমরা নিজেদের এবং আমাদের চারপাশের মানুষকে এটাও মনে করিয়ে দেব যে, আমরা যখন ভালো কাজ করি, তখন আল্লাহ তা দেখেন। কোরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা যে কোনো ভালো কাজ কর, আল্লাহ মহান তা জানেন।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯৭)
এমনকি যদি কেউ আমাদের ভালো কাজ না-ও দেখে, আল্লাহ তা-ও জানেন এবং তার প্রতিদান দেবেন। ২. তকদিরের প্রতি ইহসান
জীবনে মানুষ সুখ-দুঃখ, স্বাস্থ্য-অসুস্থতা, শক্তি-দুর্বলতা এবং প্রিয়জনের সঙ্গে মিলন ও বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে যায়। যখন নিয়ামত পাওয়া যায়, তখন আমরা খুশি হই, কিন্তু যখন পরীক্ষা আসে, তখন আমরা দুঃখ পাই বা কখনো হতাশ হয়ে পড়ি। তাহলে কীভাবে আমরা তকদিরকে ভালোভাবে গ্রহণ করব?
এটা তখন সম্ভব হবে, যখন বুঝব যে, সবকিছু আল্লাহর এবং তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যা ইচ্ছা করেন। তিনি যা দেন প্রজ্ঞার সঙ্গে দেন এবং সেভাবেই বঞ্চিত করেন। কোরআনে বলা হয়েছে, “হয়তো তোমরা কোনো কিছু অপছন্দ কর, অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর হয়তো তোমরা কোনো কিছু পছন্দ কর, অথচ তা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। আল্লাহ জানেন, আর তোমরা জানো না।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ২১৬)
৩. নিজের প্রতি ইহসান
নিজের প্রতি ইহসান দুটি দিকে বিভক্ত: শরীরের প্রতি ইহসান এবং আত্মার প্রতি ইহসান।
ক. শরীরের প্রতি ইহসান
শরীরের প্রতি ইহসানের অনেক রূপ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ: পুষ্টিকর ও উপকারী খাবার খাওয়া এবং এমন খাবার এড়িয়ে চলা, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর বা নিষিদ্ধ। কোরআনে আসহাবে কাহফের কথা বলা হয়েছে, যারা বলেছিল, “তোমাদের মধ্য থেকে একজনকে এই মুদ্রা নিয়ে শহরে পাঠাও। সে দেখুক কোন খাবার সবচেয়ে ভালো এবং তা থেকে তোমাদের জন্য খাদ্য নিয়ে আসুক১” (সুরা কাহফ, আয়াত: ১৯)
প্রিয় খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রেও সংযমী হতে হবে, কারণ অতিরিক্ত খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
কাজে ভারসাম্য: এমন কাজ করা উচিত নয়, যা শরীরকে অসুস্থ বা দুর্বল করে ফেলে।
অনেকে পিতামাতার চাহিদা পূরণ করে বটে, কিন্তু কণ্ঠে বা মুখের ভাবে বিরক্তি ফুটে ওঠে, যা পিতামাতাকে আর কিছু চাইতে নিরুৎসাহিত করে।
বিনোদন: রাসুল (সা.) বলেছেন, “এক ঘণ্টা কাজ এবং এক ঘণ্টা বিনোদন” (শুআবুল ঈমান, হাদিস: ৪৬৮৮)। তবে এই বিনোদন এমন হতে হবে যা শরিয়তের নিষিদ্ধ নয়। খেলাধুলা, গল্পগুজব বা বিশ্রাম এমন হতে হবে, যাতে গীবত বা পরচর্চা না থাকে।
নিজেকে সুন্দর রাখা: রাসুল (সা.) বলেছেন, “যার চুল আছে, সে যেন তার মর্যাদা দেয়।” (আবু দাউদ, হাদিস: ৪১৬৩)
তিনি আরেকবার একজনের উষ্কখুষ্ক চুল দেখে বলেছিলেন, “হয় তোমার চুল ভালোভাবে রাখো, নয়তো তা কামিয়ে ফেলো।” একইভাবে দাঁত ও শরীরের অন্যান্য অঙ্গের যত্ন নেওয়াও ইহসানের অংশ।
খ. আত্মার প্রতি ইহসান
আত্মার প্রতি ইহসানের মধ্যে রয়েছে:
জ্ঞান অর্জন: জ্ঞান বাড়লে মানুষ মহান আল্লাহর রহমত ও নৈকট্য বুঝতে পারে এবং জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে শেখে।
জিকির: জিকির হৃদয়কে শান্তি দেয়। রাসুল (সা.)-এর শেখানো নিয়মিত জিকির আত্মাকে আল্লাহর সঙ্গে সংযুক্ত রাখে।
চিন্তাভাবনা: আল্লাহর সৃষ্টির সৌন্দর্য নিয়ে চিন্তা করা এবং অতীত ও বর্তমান থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হওয়া।
আত্মার পরিশুদ্ধি: নিজের নৈতিকতা ও বুদ্ধিমত্তাকে উন্নত করা। কোরআনে বলা হয়েছে, “যারা কথা শোনে এবং তার মধ্যে সবচেয়ে ভালোটি অনুসরণ করে, তারাই আল্লাহ মহানের পথপ্রাপ্ত এবং বুদ্ধিমান।” (সুরা যুমার, আয়াত: ১৮) ৪. মানুষের প্রতি ইহসান
সাধারণ মানুষের প্রতি ইহসান
কিছু মানুষ শুধু সচ্ছল অবস্থায় ভালো কাজ করে, কিন্তু কঠিন সময়ে তা বন্ধ করে দেয়। আর কিছু মানুষ কঠিন সময়েও ইহসান চালিয়ে যায়, বিশ্বাস করে যে আল্লাহ মহান বলেছেন, “তোমরা যা কিছু খরচ কর, তিনি তার প্রতিদান দেবেন। তিনি সর্বোত্তম রিজিক-দাতা।” (সুরা সাবা, আয়াত: ৩৯)
আমর ইবনে ইয়াসির (রা.) বলেছেন, “তিনটি গুণ যার মধ্যে আছে, সে ইমান পূর্ণ করেছে: নিজের প্রতি ইনসাফ করা, সবার প্রতি সালাম দেওয়া এবং কঠিন অবস্থায়ও দান করা।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৩)
কেউ কেউ তাদের খাবার, কাপড়, বাসস্থান বা সময় ভাগ করে নেয়। আর কেউ কেউ নিজের চাহিদার চেয়ে অন্যের চাহিদাকে প্রাধান্য দেয়। কোরআনে তাদের প্রশংসা করা হয়েছে, “তারা নিজেদের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও অন্যকে প্রাধান্য দেয়।” (সুরা হাশর, আয়াত: ৯)
একজন নারী একটি তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি পান করিয়ে ক্ষমা পেয়েছিলেন।
সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৩২১
পিতামাতার প্রতি ইহসান
পিতামাতার প্রতি ইহসান কেবল তাদের চাহিদা পূরণ বা সেবা করার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর মধ্যে আন্তরিক ভালোবাসা, মুখের হাসি এবং এমন কণ্ঠস্বর থাকতে হবে, যাতে বিরক্তি প্রকাশ না পায়। অনেকে তাদের চাহিদা পূরণ করে বটে, কিন্তু কণ্ঠে বা মুখের ভাবে বিরক্তি ফুটে ওঠে, যা পিতামাতাকে আর কিছু চাইতে নিরুৎসাহিত করে। কিন্তু সত্যিকারের ইহসানকারী তাদের চাহিদা পূরণ হলে আনন্দ পায়।
ইবনে উমর (রা.) একজন বেদুঈনকে তার নিজের গাধায় চড়িয়েছিলেন এবং নিজের পাগড়ি তাকে দিয়েছিলেন, কারণ তিনি ছিলেন তার পিতা উমর (রা.)-এর বন্ধু। তিনি বলেছেন, “সবচেয়ে বড় ভালো কাজ হলো সন্তানের তার পিতার বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৫২)
সন্তান ও স্ত্রীর প্রতি ইহসান
সন্তানদের জন্য ইহসান হলো, একটি সুস্থ পরিবেশ তৈরি করা, সৎ সঙ্গী নির্বাচন করা, হালাল খাবার দেওয়া, শরিয়ার নির্দেশ ও জীবনের জ্ঞান শেখানো এবং তাদের সঙ্গে এমন সম্পর্ক রাখা যাতে তারা তাদের সমস্যা বাবা-মায়ের কাছে বলতে পারে।
আর স্ত্রীর প্রতি ইহসান হলো, যেমন, রাসুল (সা.) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে তার পরিবারের জন্য উত্তম।” (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৯৭৭)
তিনি নিজে ছিলেন স্ত্রীদের প্রতি সর্বোত্তম। তিনি আয়েশা (রা.)-এর সঙ্গে খেলাধুলা করতেন, তার পছন্দের জিনিস তাকে দিতেন, তার পান করা পাত্র থেকে পান করতেন, মসজিদে হাবশিদের খেলা তাকে দেখাতেন এবং তার সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতা করতেন। এমনকি খাদিজা (রা.)-এর মৃত্যুর পরও তিনি তার বান্ধবীদের উপহার পাঠাতেন এবং তার গুণকীর্তন করতেন এবং তার জন্য ভেড়া জবাই করে তার বান্ধবীদের মধ্যে বিতরণ করতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৮১৮)
৫. অন্যান্য সৃষ্টির প্রতি ইহসান
ইহসান কেবল মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি পশুপাখির প্রতিও প্রযোজ্য। রাসুল (সা.) বলেছেন, একজন নারী একটি তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি পান করিয়ে ক্ষমা পেয়েছিলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৩২১)
আদি ইবনে হাতেম (রা.) পিঁপড়ার জন্য রুটি ভেঙে দিতেন এবং বলতেন, “তারা আমাদের প্রতিবেশী, তাদেরও অধিকার আছে।”
কেউ কেউ ইহসান করে প্রতিদান আশা করে। যদি প্রতিদান না পায়, তবে তারা হতাশ হয়। কিন্তু সত্যিকারের মুমিন ইহসান করে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
ইহসান কীভাবে করব
ইহসান দুই ধরনের হতে পারে। কেউ কেউ ইহসান করে প্রতিদান আশা করে। যদি প্রতিদান না পায়, তবে তারা হতাশ হয়। কিন্তু সত্যিকারের মুমিন ইহসান করে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, কোনো প্রতিদান বা ধন্যবাদের আশা ছাড়াই। তারা বলে, “আমরা তোমাদের কাছ থেকে কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা চাই না।” (সুরা দাহর, আয়াত: ৯)
তবে ইহসান ধরে রাখা সহজ নয়। কখনো কখনো মানুষের ধৈর্য ফুরিয়ে যায়, কিন্তু আল্লাহ মহান আমাদের ইহসান চালিয়ে যেতে বলেছেন, এমনকি বিচ্ছেদের সময়েও। তিনি বলেছেন, “হয় ভালোভাবে রেখে দাও, নয়তো ভালোভাবে ছেড়ে দাও।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ২২৯)
ইহসানের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হলো আল্লাহ মহানের নিয়ামতের প্রতি ইহসান। এর মানে হলো নিয়ামতকে স্বীকার করা, আল্লাহ মহানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং কোনো নিয়ামতকে ছোট বা তুচ্ছ মনে না করা। নিয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা এর অবমাননা করে এবং তা হারিয়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে। ইহসানের মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনকে আল্লাহ মহানের সন্তুষ্টির পথে নিয়ে যেতে পারি।