ইসলামের পরিভাষায় অনেক শব্দ এমন আছে যেগুলো কোরআনের আয়াত থেকে এসেছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ তাৎপর্য বহন করেছে। ‘আর-রাহীকুল মাখতুম’ তেমনই একটি শব্দ। কোরআনে এটি জান্নাতের নিখুঁত, সুগন্ধি ও সিলমোহরযুক্ত পানীয় হিসেবে এসেছে।
তবে এই শব্দ শুধু জান্নাতের নেয়ামতের ইঙ্গিত নয়, বরং রাসুল (সা.)-এর পবিত্র জীবন ও তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার বোঝাতেও ব্যবহৃত হয়। পরবর্তী সময়ে এটি মুসলিম জগতে সবচেয়ে জনপ্রিয় সীরাত গ্রন্থের নাম হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আর-রাহীকুল মাখতুম শব্দের অর্থ
আরবি শব্দ ‘রাহীক’ অর্থ হলো—বিশুদ্ধ, নির্মল ও অমিশ্রিত পানীয়। আর ‘মাখতুম’ মানে হলো—সিলমোহর দেওয়া বা রক্ষিত। অতএব ‘আর-রাহীকুল মাখতুম’ অর্থ দাঁড়ায়: সিলমোহরযুক্ত বিশুদ্ধ পানীয়।
কোরআনে উল্লেখ
কোরআনের সুরা মুতাফ্ফিফিনে জান্নাতের নেয়ামত বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, “সত্যবাদীরা অবশ্যই নেয়ামতের মাঝে থাকবে। তাদেরকে বিশুদ্ধ পানীয় পরিবেশন করা হবে, যা সিলমোহরযুক্ত। এর শেষ অংশ হবে মিশক (কস্তুরী)।” (আয়াত: ২৫-২৬)
এখানে ‘রাহীকুল মাখতুম’ বলতে জান্নাতবাসীদের জন্য বিশেষ পানীয়কে বোঝানো হয়েছে, যা পৃথিবীর কোনো পানীয়ের সাথে তুলনীয় নয়।ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য
কোরআনের ভাষ্যকার মুফাসসিরগণ বলেন, এই পানীয়তে ৩টি গুণ থাকতে হবে:
পানীয় হবে সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ, যাতে কোনো মাদকতা বা অপবিত্রতা থাকবে না।
‘সিলমোহরযুক্ত’ মানে হলো এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে সংরক্ষিত ও বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ।
কস্তুরীর ঘ্রাণ দ্বারা শেষ করার মানে—এ পানীয়ের স্বাদ ও সুবাস হবে জান্নাতের সৌন্দর্যের প্রতীক। (আল-তাবারি, তাফসির আল-তাবারি, ভলিউম ২৪, পৃষ্ঠা ৪৫)
রাসুল (সা.)-এর জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক
মুফাসসিরগণ আরও ব্যাখ্যা করেছেন, ‘আর-রাহীকুল মাখতুম” শুধু জান্নাতের নেয়ামতের প্রতীক নয়, বরং নবীজির জীবন থেকেও আমরা এক ধরনের ‘বিশুদ্ধ পানীয়’ পাই। তাঁর জীবন একেবারেই অম্লান, নিখুঁত ও নির্মল—যেন সিলমোহরযুক্ত পাত্রে রাখা। তাঁর চরিত্রে ছিল না কোনো অপবিত্রতা, বরং সত্য, ন্যায় ও সৎকর্মের বিশুদ্ধ প্রতিফলন। এমনকি তার হৃদয়ে যেন কোনো কদর্যতা স্থান না পায়, সেজন্য বেশ কয়েকবার তার বক্ষ বিদীর্ণ করে জমজম কূপের পানি দিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৬০৭৭)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন থেকেই মানুষ দুনিয়ার সঠিক পথ ও আখিরাতের মুক্তির নিশ্চয়তা পায়। তাই অনেক ইসলামি সাহিত্যিক ‘আর-রাহীকুল মাখতুম’ শব্দকে রূপকভাবে নবীজির সীরাত বা তাঁর চরিত্র বোঝাতেও ব্যবহার করেছেন।গ্রন্থ : আর-রাহীকুল মাখতুম
পরে এই শব্দকে কেন্দ্র করে এক অসাধারণ সীরাতগ্রন্থ রচিত হয়। লেখক সাফিউর রহমান মুবারকপুরী (১৯৪৩–২০০৬), ভারতের উত্তর প্রদেশের মুবারকপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে সৌদি আরবের মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনী নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সারা বিশ্ব থেকে প্রায় ১৭০০ বই জমা পড়ে। সবার মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে ‘আর-রাহীকুল মাখতুম’। (সাফিউর রহমান মুবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতুম, দারুস সালাম পাবলিশারস, ১৯৭৬)
বইটি এতটাই সহজ, প্রাঞ্জল ও তথ্যসমৃদ্ধ যে এটি পৃথিবীর প্রায় সব প্রধান ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বাংলা অনুবাদও ব্যাপকভাবে প্রচলিত।
আজকের অস্থির দুনিয়ায় মানুষ বিশুদ্ধতা খুঁজে বেড়ায়। রাহীকুল মাখতুম যেমন জান্নাতের এক বিশুদ্ধ পানীয়ের প্রতিশ্রুতি, তেমনি নবীজির সীরাতও আমাদের জন্য দুনিয়ায় এক বিশুদ্ধ জীবনের পথনির্দেশ। আর শাইখ মুবারকপুরীর রচিত বইটি আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে সেই জীবনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র