শান্তিপূর্ণ স্লোগানমুখর ছিল কলতাপাড়া বাজার। মিছিলটি মসজিদের কাছাকাছি আসতেই গুলি ছুড়ে পুলিশ। উল্টো দৌড় দেন; কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি তার, পুলিশের ছোড়া বুলেট বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়। তখন দেখলাম বুকের ফুসফুস আর মাংসপিণ্ড যেন ২-৩ ফুট দূরে উড়ে গেছে। শরীরে কেমন জানি একটা শট লাগল, ঝাঁকুনি দিল। মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম।
কথাগুলো বলছিলেন জুলাইযোদ্ধা মাহবুবুল আলম জুনায়েদ।
তিনি আরও বলেন, জ্ঞান হারানোর ৩ দিন পর ২৩ জুলাই রাত ৩টা ১৭ মিনিটের দিকে জ্ঞান ফিরেছে। এরপর জানলাম আমাকে বাঁচাতে তখন ৯ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে।
জুনায়েদ বলেন, কিশোরগঞ্জগামী একটি অ্যাম্বুলেন্স আটকিয়ে আমাকে ছাড়াও আরও ৬-৭ জনকে একসঙ্গে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। আমি মরে গেছি বা বাঁচব কিনা- সেই আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন সহযোদ্ধারাও।
তিনি আরও বলেন, মৃত বা জীবিত ভেবে একসঙ্গে পাঠানো হলেও সেখানে ৩ জন মারা যান। প্রিয় সহযোদ্ধাদের সেই লাশের সাথেই তো ‘লাশের মতো’ আমিও ছিলাম। মহান সৃষ্টিকর্তা সেই লাশটাকে অলৌকিকভাবেই প্রাণ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখলেন।
মাহবুবুল আলম জুনায়েদ ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর ইউনিয়নের গুজিখাঁ গ্রামের মো. আব্দুল মালেকের পুত্র। তার বাবা পেশায় মসজিদের ইমাম আর মা ঝরনা বেগম একজন গৃহিণী। দুই ভাই আর এক বোনের মধ্যে সে সবার বড়।
ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের কলতাপাড়ায় গত বছরের ২০ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালনের সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তিনি বর্তমানে ময়মনসিংহ পলিটেকনিক্যাল কলেজে ইলেক্ট্রো মেডিকেল বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। তার ছোট ভাই জুবায়ের আহমেদ ঈশ্বরগঞ্জের রাজিবপুরে একটি মাদ্রাসায় হেফজ বিভাগে এবং ছোট বোন মাইশা আক্তার হাফসা গুজিখাঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।
এ আন্দোলন প্রসঙ্গে জুনায়েদ জানান, কলেজে একাধিক মিছিল-মিটিংয়ে গিয়েছি। তারপর দেশের পরিস্থিতি ভালো না বললো ‘বাবা।’ তাই বাড়িতে চলে আসলাম। কিন্তু আন্দোলনরত ভাই-বোনদের ওপর যে হামলা হচ্ছে, হত্যা করা হচ্ছে। সেগুলো দেখে আর ঠিক থাকতে পারি নাই। ১৭ জুলাই বাড়িতে আসলাম। ১৯ জুলাই জুমার নামাজ শেষে কলতাপাড়া শান্তিপূর্ণ মিছিল করা হলো। এরপরে ২০ জুলাই কর্মসূচি দেওয়া হয়। সেদিনও সকালে শান্তিপূর্ণ মিছিল ও সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করছিলাম। ওই দিন কারফিউ ছিল। তা ভেঙে রাজপথে আন্দোলন চলছিল। পুলিশ বিনা উস্কানিতে হামলা চালায়। গৌরীপুর থানার তৎকালীন সাব-ইন্সপেক্টর শফিকুল আলমই গুলি করেছিল বলে পরে জানতে পারি।
জুলাই বিপ্লবে দেশে প্রথম কারফিউ ভেঙে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ আন্দোলনে শহীদ হন ৩ জন। তারা হলেন- উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের চুড়ালী গ্রামের মো. বাবুল মিয়ার পুত্র বিপ্লব হাসান, মইলাকান্দা ইউনিয়নের পূর্বকাউরাট গ্রামের জোবায়ের আহম্মেদ ও রামগোপালপুর ইউনিয়নের দামগাঁও গ্রামের নুরে আলম সিদ্দিকী রাকিব। আহত হন আরও শতাধিক ছাত্র-জনতা।
আন্দোলন প্রসঙ্গে মাহবুবুল আলম জুনায়েদ বলেন, এখনো অনেক সহযোদ্ধা আহত, তাদের দ্রুত চিকিৎসার দাবি জানাচ্ছি। যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি, তা যেন পুনরায় ঘাঁটি করতে না পারে। দেশের চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভালো না। দেশের ধর্ষণ-খুন বেড়ে যাচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা স্লোগান দিয়েছি। এখনো দুর্নীতি বন্ধ হয়নি।
জুনায়েদের চাচাতো ভাই শাহিনুর রহমান জানায়, ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ এ প্রবাদের শতভাগ জুনায়েদের জীবনে বাস্তবায়িত হয়েছে। সে বাঁচবে, বেঁচে থাকবে, তা ডাক্তারও আশা করে নাই। যার বুক ছিঁড়ে গুলি বেড়িয়ে গেছে। সে বাঁচবে, কেউ কল্পনা করে নাই।
তিনি আরও বলেন, জুনায়েদ গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সেই খবর শুনে, আমরা যখন কলতাপাড়ায় যাই- একপর্যায়ে আমরাও পুলিশের ব্যারিকেডে পড়ে যাই। সেদিন জীবন বাঁচাতে আমাদের জঙ্গলে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।