রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদের কারণে বহুল আলোচিত জুলাই সনদ জুলাই মাসে চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। আগস্টের চতুর্থ সপ্তাহে এসেও রাজনৈতিক দলগুলো সনদের বিষয়ে একমত হতে পারছে না; এটা অবশ্যই উদ্বেগের কারণ।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদের সর্বশেষ যে খসড়া রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠিয়েছে, তা নিয়ে নতুন জটিলতা তৈরি হয়েছে। কমিশনের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে ২৬টি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদ পর্যালোচনা করে মতামত জানালেও চারটি দল মতামত দেয়নি। তবে মূল সমস্যা এখানে নয়। সনদের বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া তথা আইনি ভিত্তি নিয়েই বড় ধরনের বিরোধ দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রাথমিক খসড়ায় বলা হয়েছে, পরবর্তী জাতীয় সংসদ দুই বছরের মধ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কিছু দল এ ব্যাপারে আপত্তি জানায়। তাদের মতে, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না থাকলে পরবর্তীকালে এটি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। এ ক্ষেত্রে তারা নব্বইয়ে ঘোষিত তিন জোটের রূপরেখার উদাহরণ দেয়।
বিএনপি ও তার সহযোগী দলগুলো মনে করে, জুলাই সনদের কিছু বিষয় অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যায়। আর যেসব বিষয়ের সঙ্গে সাংবিধানিক প্রশ্ন জড়িত, সে বিষয়গুলো পরবর্তী জাতীয় সংসদে অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। কিন্তু এনসিপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কিছু দল জুলাই সনদ পুরোটাই নির্বাচনের আগে বাস্তবায়নের পক্ষে। এ ক্ষেত্রে এনসিপি গণপরিষদের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং জামায়াত গণভোট বা রাষ্ট্রপতির প্রোক্লেমেশনের মাধ্যমে বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে।
আলোচনায় এসেছে একই সঙ্গে গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়টিও। ঐকমত্য কমিশন তা আনুষ্ঠানিকভাবে না জানানোয় বিএনপি কোনো মন্তব্য করেনি। জামায়াত একই দিনে গণভোট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিপক্ষে। তাদের মতে, সে ক্ষেত্রে কমিশনের প্রস্তাবে যে উচ্চকক্ষের কথা আছে, সেটি পরিত্যাজ্য হয়ে যাবে।
জুলাই সনদের খসড়ায় বলা হয়েছিল, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও জুলাই সনদই অগ্রাধিকার পাবে। বিএনপি ও এর সহযোগীরা কোনোভাবে এটি মানতে নারাজ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, সংবিধান হলো দেশের সর্বোচ্চ আইন। জুলাই সনদকে এর ওপরে স্থান দেওয়া হবে অবৈধ ও অগ্রহণযোগ্য। ঐকমত্যের দলিলে সংবিধান-বহির্ভূত কিছু বিষয় সন্নিবেশিত হতে পারে না। জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করে বলেছেন, যেহেতু জুলাই সনদে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে, সেহেতু একে সংবিধানের ওপরে স্থান দিতে হবে।
অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি নতুন সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে গণপরিষদ বা সংবিধান সভা নির্বাচনের দাবি সামনে নিয়ে এসেছে। তারা বলেছে, জুলাই সনদের পরিপন্থী কোনো কিছু সংবিধানে থাকতে পারবে না। বহুদলীয় গণতন্ত্রে মত ও পথের ফারাক থাকবে। সেটি মেনে নিয়েই রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। এর মধ্যে রাজনৈতিক বাস্তবতাও স্বীকার করতে হবে। সংবিধান সংশোধন বা নতুন সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান সংবিধানকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না।
সমঝোতায় পৌঁছাতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আরও এক মাস বাড়ানো হয়েছে, যা সেপ্টেম্বর মাসের ১৫ তারিখ শেষ হওয়ার কথা। হাতে যেহেতু বেশি সময় নেই, তাই আলোচনা দ্রুত শেষ করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সরকার বা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি দায়িত্ব আছে রাজনৈতিক দলগুলোরও। ভবিষ্যতে রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে, সে বিষয়ে তাদের ঐকমত্যে আসতেই হবে।
এ অবস্থায় কোনো দলের এমন কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে নির্বাচনপ্রক্রিয়া শুরু করতে বিলম্ব হয়। দেশবাসী একটি অবাধ, সুষ্ঠু, উৎসবমুখর নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এ অপেক্ষা দীর্ঘায়িত করার কোনো সুযোগ নেই।