দেবী দুর্গার পরিবারের একজন সদস্য, যিনি সবার থেকে আলাদা, যিনি দুর্গার মানসপুত্র, নাম গণেশ। গণেশ নামের অর্থ ‘জনগণের প্রভু’। তাঁর নাদুসনুদুস চেহারাটির ওপর মাথাটি শুঁড়সহ একটি হাতির। এই নান্দনিকতার জন্য ভারতীয় উপমহাদেশে শিল্পজগতে অতি জনপ্রিয় হলো এই গণেশপ্রতিমা।
গণেশের দেহে হাতির মাথা কীভাবে স্থাপিত হয়েছিল, এ নিয়ে হরেক রকম কাহিনি প্রচলিত আছে। শিবপুরাণের কাহিনিতে জানা যায়, পার্বতী যখন স্নান করতে যেতেন, তখন তাঁর ঘরের দরজা পাহারা দিত এই শিশুপুত্র। পার্বতী দুর্গার অপর নাম। পার্বতীর আদেশ ছিল, তাঁর অবর্তমানে কাউকে এই ঘরে ঢুকতে না দেওয়া। একদিন ভবঘুরে শিব সদলবল এসে ঘরে ঢুকতে চাইলে গণেশের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। তখন গণেশের সঙ্গে শিবের যুদ্ধ বাধে। সেই যুদ্ধেই শিবের ত্রিশূলের আঘাতে গণেশের মুণ্ডুচ্ছেদ হয়।
স্নান সেরে এসে পুত্রের এমন অবস্থা দেখে পার্বতী রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন। তখন স্বর্গের দেবতারা তাঁকে শান্ত করতে চেষ্টা করলে পার্বতী দুটি শর্ত দেন।
ভবঘুরে শিব সদলবল এসে ঘরে ঢুকতে চাইলে গণেশের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। তখন গণেশের সঙ্গে শিবের যুদ্ধ বাধে। সেই যুদ্ধেই শিবের ত্রিশূলের আঘাতে গণেশের মুণ্ডুচ্ছেদ হয়।
প্রথমটি হলো, পুত্রের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে হবে আর দ্বিতীয়টি, তাঁর পুত্রকে সব দেবতার আগে পূজা করার ব্যবস্থা করতে হবে। দেবতারা দুটি দাবি মেনে নিয়ে শিবের কাছে গিয়ে গণেশের প্রাণভিক্ষা চান। শিব তখন অনুচরদের আদেশ দেন, উত্তর দিকে মুখ করে আছে, এমন কোনো প্রাণীকে দেখতে পেলেই যেন তার মুণ্ডু কেটে নিয়ে আসে। শিবের আদেশে অনুচরেরা একটি হাতির শাবককে দেখতে পায় এবং তার মাথা নিয়ে এলে মস্তকহীন গণেশের দেহে তা প্রতিস্থাপন করে গণেশের আবার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ভিন্ন আরও কিংবদন্তি আছে।একবার ঋষি নারদ একটি আম এনে শিব আর পার্বতীকে উপহার দেন। মা–বাবাকে নারদমুনির দেওয়া আম নিয়ে তাঁদের দুই পুত্র গণেশ ও কার্তিকের মধ্যে ঝগড়া লাগে। কারণ, কে হবে আমের ভাগীদার। শিব ও পার্বতী পুত্রদ্বয়ের বিবাদ দেখে মহা মুশকিলে পড়লেন। শিব উপায় খুঁজতে লাগলেন সমাধানের। তিনি পুত্রদের প্রস্তাব দিলেন, তাদের মধ্যে যে আগে পৃথিবী পরিক্রমণ করতে পারবে, তাকেই আমটি দেওয়া হবে। এমন লোভনীয় প্রস্তাব শুনে তাড়াতাড়ি কার্তিক বাহন ময়ূরকে ডেকে নিয়ে তার পিঠে চেপে বসে পৃথিবী পরিক্রমায়। এদিকে বড় ভাই গণেশের সে রকম কোনো ব্যস্ততা দেখা গেল না। একদম চুপ থেকে শিব ও পার্বতীকে তিন–তিনবার প্রদক্ষিণ করে নিয়ে বলল, ‘পিতা-মাতাই তো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।’ গণেশের এমন কীর্তি দেখে শিব ও পার্বতী দুজনেই খুব খুশি। শিব গণেশের এমন বুদ্ধি দেখে তার হাতেই আমটি তুলে দেয়।
কোনো এক চতুর্থীতে আকাশের চাঁদ গণেশের মস্ত পেট নিয়ে রসিকতা করেছিল। এর জন্য গণেশ বেশ রাগ করেন। চাঁদকে বলেন, ‘তুমি কোনোদিনই পূর্ণতা নিয়ে টিকে থাকবে না।’
গণেশের এমন ধীশক্তির জন্য তাঁকে সিদ্ধিদাতা গণেশও বলা হয়ে থাকে। পুরাণে কিংবদন্তি আছে, একবার কোনো এক চতুর্থীতে আকাশের চাঁদ গণেশের মস্ত পেট নিয়ে রসিকতা করেছিল। এর জন্য গণেশ বেশ রাগ করেন। রাগের মাথায় চাঁদকে অভিশাপ দেন। বলেন, ‘তুমি কোনোদিনই পূর্ণতা নিয়ে টিকে থাকবে না।’ পূর্ণিমার দিন চাঁদ পূর্ণ হলেও কিন্তু এর স্থায়িত্ব খুব কম সময়ের।
হিন্দু পুরাণে জানা যায়, গণেশ চতুর্থী তিথিতে কৈলাস পর্বত থেকে সিদ্ধিদাতারূপী গণেশ বাহন ইঁদুর বা মূষিককে সঙ্গে নিয়ে ভক্তদের প্রার্থনা পূরণ করতে মর্ত্যলোকে নেমে আসেন। কখনো কখনো তাঁর বাহন হিসেবে সিংহকেও দেখা যায়। ভক্তদের কাছে তিনি মহাবলী। মেধা ও বুদ্ধির দেবতাও বটে।
ভাদ্র মাসের তীব্র গরমে শুক্লা চতুর্থীর দিন গণেশ চতুর্থী উদ্যাপন করা হয় ঠিকই, তবে সনাতন বাঙালি ব্যবসায়ীরা কিন্তু বৈশাখের প্রথম দিন অর্থাৎ নববর্ষের দিনই প্রথমে গণেশ পূজা করে সারা বছরের ব্যবসায়িক যাত্রা শুরু করেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের যেকোনো শুভানুষ্ঠানে গণেশবন্দনা বা পূজার চল বহুকাল ধরেই বহাল।
ভাদ্র মাসের গণেশ পূজা ইদানীং সনাতন বাঙালি পাড়াগুলোয় সাড়া জাগালেও এককালে তা একেবারেই ছিল না। ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তের মহারাষ্ট্রের প্রধান উৎসব হলো গণেশ চতুর্থী। মহারাষ্ট্রজুড়ে গণেশ চতুর্থী সবচেয়ে বড় উৎসব বা পার্বণ হিসেবে উদ্যাপন করা হয়ে থাকে। সব মারাঠিই এই উৎসবে শামিল হন। মণ্ডপে মণ্ডপে মাটির বিভিন্ন মাপের গণেশ প্রতিমা বসে। ব্রাহ্মণ পুরোহিত পূজা–অর্চনা করে সেই মাটির প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। পূজা, ভোগ, আরতি ও বিচিত্রানুষ্ঠান সারা দিনব্যাপী চলতে থাকে। মহারাষ্ট্রের বাইরে দক্ষিণ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কর্নাটক ও গোয়ায়ও গণেশ পূজার চল দেখা যায়।
তবে গণেশের আরাধনা খুবই প্রাচীন। পাঁচ হাজার বছর আগে অর্থাৎ সেই বৈদিক যুগের আগে থেকেই গণেশের প্রতিমা ভারতীয় উপমহাদেশে খুবই জনপ্রিয়। বৈদিক ও প্রাক্–বৈদিক যুগেও গণেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। সর্বত্রই মঙ্গলের প্রতীক হলো গণেশ।
বালগঙ্গাধর তিলক ১৮৯২ সালে পুনে শহরে প্রথম সর্বজনীন গণেশ চতুর্থী উদ্যাপন শুরু করেন। সে সময়ে ব্রিটিশ সরকার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সব রকমের সভা, সমাবেশ, জমায়েত ইত্যাদি নিষিদ্ধ করেছিল।
মহারাষ্ট্রে গণেশ ‘বিনায়ক’ নামে বিশেষ পরিচিত। তামিলনাড়ুতে ‘পিলায়ার’এবং কেরেোয় ‘লম্বুধারা পিরানালু’ এমন অনেক নামেই বিভিন্ন জায়গায় পরিচিতি। মারাঠা বীর শিবাজী খুব ধুমধাম করে গণেশ উৎসব উদ্যাপন করতেন।
১৬৩০ থেকে ১৬৮০ সাল নাগাদ মোগলদের বিরুদ্ধে শিবাজী যুদ্ধরত প্রজাদের জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করতে গণেশ চতুর্থী বা গণপতি উৎসব উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। এর প্রায় দুই শ বছর পর বালগঙ্গাধর তিলক ১৮৯২ সালে পুনে শহরে প্রথম সর্বজনীন গণেশ চতুর্থী উদ্যাপন শুরু করেন। সে সময়ে ব্রিটিশ সরকার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সব রকমের সভা, সমাবেশ, জমায়েত ইত্যাদি নিষিদ্ধ করেছিল। সরকারের এই জনবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বালগঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে মহারাষ্ট্রের সর্বত্র গণেশ পূজার প্রসার ও প্রচার ব্যাপক হারে স্বল্পকালের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুসারে বর্তমানে ১০ দিনব্যাপী গণেশ চতুর্থী উৎসব উদ্যাপিত হয়।
তবে শুধু ভারতের মাটিতেই গণেশ পূজা হয়, এমন ধারণাও সম্পূর্ণ সঠিক নয়। নেপাল, চিন, কম্বোডিয়া, তিব্বত, থাইল্যান্ড, জাভা, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন স্থানেও গণেশ দেবতা রূপে পূজিত হন। ইদানীং যুক্তরাষ্ট্রে ও ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রেও প্রবাসী সনাতনেরা খুব জাঁকজমক করে গণেশ চতুর্থী উদ্যাপন করে থাকেন।