গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কৃতিতে পরিবর্তন না আসাটা একই সঙ্গে উদ্বেগ ও হতাশার। দেশের তরুণ প্রজন্মের চূড়ান্ত আত্মত্যাগেরই অর্জন এ অভ্যুত্থান, আর এর প্রধানতম জন–আকাঙ্ক্ষাটি হচ্ছে মানুষ আর পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায় না।
রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকার ও শাসনব্যবস্থায় যেসব বিধিবিধান অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের ভিত্তি গড়ে দিয়েছে, তার খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারপ্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, দলগুলো মুখে সংস্কারের কথা বললেও চর্চার দিক থেকে সেই পুরোনো ও পতিত কর্তৃত্ববাদী সংস্কৃতিরই চর্চা করে চলেছে, যেটা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক রূপান্তরযাত্রার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
গত এক বছরের রাজনৈতিক চর্চা নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি) উদ্বেগ জানিয়ে ২৪ আগস্ট যে বিবৃতি দিয়েছে, সেটা নাগরিকের আশঙ্কারই প্রতিধ্বনি বলে আমরা মনে করি। সংস্থাটি বলেছে, রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের একাংশ যেভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করছে এবং যেভাবে ‘এবার আমাদের পালা’ সংস্কৃতির চর্চা করছে, সেটা নতুন বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত।
আমরা দেখেছি যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও দলবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মামলা–বাণিজ্য, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি লুট, গ্রেপ্তার–বাণিজ্য, আধিপত্য বিস্তারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সহিংসতার মতো কর্তৃত্ববাদী চর্চাগুলো এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। শুধু পুরোনো মুখের জায়গায় নতুন মুখ এসেছে। নতুন করে যুক্ত হয়েছে তকমা লাগানোর সংস্কৃতি ও মব সহিংসতা। কিছু কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী নিজেদের অতিক্ষমতায়িত ভাবতে শুরু করেছে এবং মব সহিংসতা অব্যাহত রেখেছে। ফলে নারী, আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়েছে, কোথাও কোথাও তারা আক্রান্তও হয়েছে। আমরা মনে করি, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা এবং নাগরিকের অধিকার প্রশ্নে নাগরিকের পাশে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর দাঁড়াতে না পারার ব্যর্থতাই এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
বিবৃতিতে টিআইবি স্পষ্ট করে বলেছে, পরিবহন টার্মিনাল, খনিজ সম্পদ, সেতু, বাজার ও জলমহালের দখল ও চাঁদাবাজ চক্রের পুনরুত্থানও রাজনৈতিক অঙ্গনে অতীতের কর্তৃত্ববাদী শাসনের ধারাবাহিকতাকে জিইয়ে রাখছে। সিলেটে পাথর লুটের ক্ষেত্রে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপির সঙ্গে পতিত আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের যে ঐকমত্য আমরা দেখলাম, তাতে শঙ্কিত না হয়ে পারি না।
চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও জাতীয় সম্পদ লুটের এ প্রবণতা যত দিন গড়াচ্ছে, ততই বাড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপির উচ্চপর্যায় থেকে নেতা–কর্মীদের সতর্ক করার পাশাপাশি সংগঠন থেকে বহিষ্কারের মতো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এই ব্যাধি কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের এতটা গভীরে গেড়ে বসেছে যে নেতা–কর্মীদের ওপর দলের নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ কতটা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলের একাংশও এ ধরনের চর্চার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।
আমরা মনে করি, এ বাস্তবতা তৈরির পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনেরও দায় আছে। কেননা কার্যকর প্রতিরোধে তারা শুধু ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে না, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহায়ক ও সুরক্ষাকারীর ভূমিকাও নিচ্ছে। আওয়ামী লীগের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে শুধু চূড়ান্তভাবে দলীয়করণই করা হয়নি; বরং তাদের একটা অংশকে দুষ্কর্মের দোসরে পরিণত করা হয়েছিল। কোনোভাবেই এর পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, তার দিকে অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ—সবাইকেই সতর্ক থাকতে হবে।
চব্বিশের অভ্যুত্থান কর্তৃত্ববাদী শাসনের বৃত্ত থেকে বের হয়ে নতুন বাংলাদেশ তথা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে যাত্রার একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এ সুযোগকে নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।