তিনি পরিচিত হাফেজ ইবনে হাজার আল-আসকালানি নামে। তাঁর পুরো নাম আহমদ বিন আলী বিন মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ বিন আলী। ডাকনাম ইবনে হাজার, আর উপাধি শিহাবুদ্দিন, অর্থাৎ ‘দ্বীনের দীপ্ত আলো’। জ্ঞানের ভুবনে তাঁর পদচারণ ইতিহাসে একটি অমর দৃষ্টান্ত।
তিনি ৭৭৩ হিজরি সনে মিসরের কায়রো শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ফিলিস্তিনের আসকালান অঞ্চলের অধিবাসী হওয়ায় তাঁকে ‘আসকালানি’ বলা হয়। (শাজারাতুজ জাহাব: ৯/৩৯৫, দার ইব্ন কাসির, বৈরুত: ১৯৯৩)
শৈশবের তিক্ত অভিজ্ঞতা
শৈশবেই তাঁর জীবন ছিল তিক্ত ও বিষাদময়। তিনি মাত্র চার বছরের শিশু থাকতেই পিতা–মাতা উভয়ের চিরবিদায় প্রত্যক্ষ করেন। তবে মৃত্যুর আগে তাঁর পিতা একজন যোগ্য অভিভাবক নিযুক্ত করে যান, যিনি ইবনে হাজারের পরবর্তী জীবনে উজ্জ্বল পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন। (শাজারাতুজ জাহাব: ৯/৩৯৫, দার ইব্ন কাসির, বৈরুত: ১৯৯৩)
মাত্র চার বছরের শিশু থাকতেই পিতা–মাতা উভয়ের চিরবিদায় প্রত্যক্ষ করেন। তবে মৃত্যুর আগে তাঁর পিতা একজন যোগ্য অভিভাবক নিযুক্ত করে যান।
ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রতিভা ও মেধার অধিকারী। সে যুগে আল্লামা শামসুদ্দিন জাহাবি (রহ.)-এর স্মৃতিশক্তি ছিল প্রবাদতুল্য। বর্ণিত আছে, ইবনে হাজার মেধায় তাঁর সমতুল্য হওয়ার দোয়া করেন এবং ফলস্বরূপ তিনিও সেই মেধার অধিকারী হন। (ভূমিকা, তারিখুল ইসলাম: ১/১০, আল-মাকতাবাতুত তাওফিকিয়্যা, কায়রো)
কৈশোরে পা রাখার আগেই তিনি হয়ে ওঠেন সত্যিকারের একজন কোরআনপ্রেমী। ফলে ৯ বছর বয়সে পূর্ণ কোরআন হিফজ সম্পন্ন করেন। তারপর মুখস্থ করেন উমদাতুল আহকাম ও আল-ফিয়াতুল ইরাকি। অতঃপর নিয়মিত আলেমদের কাছে পড়াশোনা শুরু করেন। (ভূমিকা, তাহজিবুত তাহজিব: ১/৩২, দারুল হাদিস, কায়রো: ২০১০)
জ্ঞানার্জনে অক্লান্ত সাধনা
ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.)-এর শিক্ষাজীবন ছিল একান্তই জ্ঞানসাধনায় নিবেদিত। তিনি জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে সফর করেন মক্কা, ইয়েমেন, মিসর, শাম ও হিজাজ—ইসলামি জ্ঞান ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিক কেন্দ্রগুলোতে। এসব স্থানে তিনি সময়ের শ্রেষ্ঠ আলেমদের সান্নিধ্যে উপনীত হোন এবং তাঁদের কাছ থেকে কিরাত, হাদিস, ফিকহসহ বিভিন্ন শাস্ত্রে গভীর জ্ঞান আহরণ করেন।
বিশেষত হাদিসশাস্ত্রে তিনি অনন্য পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এ শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জনের জন্য তিনি ১০ বছর আল্লামা ইরাকি (রহ.)-এর সান্নিধ্যে কাটান। ফিকহশাস্ত্রে তাঁর শিক্ষক ছিলেন খ্যাতিমান আলেম আল্লামা বুলকিনি (রহ.)। তাঁর সান্নিধ্যে অবস্থান করে তিনি এ শাস্ত্রে সুদৃঢ় দক্ষতা অর্জন করেন।
ইবনে হাজারের মৃত্যুর পর হাদিস বিশারদদের কেউই তাঁর সমকক্ষ হতে পারেননি।
আল্লামা সাখাভি (রহ.), ভূমিকা, তাহজিবুত তাহজিব: ১/৩৭
কিরাতশাস্ত্রে তাঁর প্রথম শিক্ষক ছিলেন শাইখ তানুখি (রহ.)। এ শাস্ত্রে আংশিক শিক্ষা লাভের পর তিনি গমন করেন শাইখ বদরুদ্দিন বিন জামাআ (রহ.)-এর কাছে। এ–বিষয়ক পূর্ণ জ্ঞান তিনি তাঁর কাছ থেকেই অর্জন করেন। (ভূমিকা, তাহজিবুত তাহজিব: ১/৩৩-৩৫, দারুল হাদিস, কায়রো: ২০১০)
তাঁর এ কঠোর পরিশ্রমের জ্ঞান সাধনাই একদিন গড়ে তোলে এক যুগশ্রেষ্ঠ আলেমকে।
রচনাবলি
লেখালিখির জগতেও ইবনে হাজার ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর রচিত বহু গ্রন্থ জ্ঞানীমহলে প্রশংসিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি খ্যাতি লাভ করেছে ফাতহুল বারি, যা সহিহ বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থ হিসেবে পুরো মুসলিম জগতে সমাদৃত।
এ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো লিসানুল-মিজান, তাহজিবুত তাহজিব, তাক্বরিবুত তাহজিব, বুলুগুল মারাম, আদ দিরায়া ফি তাখরিজি আহাদিসিল-হিদায়া, তাগলিকুত তা’লিক, নুখবাতুল-ফিকার, আল-ইসাবা ফি তাময়িজিস সাহাবা প্রভৃতি। (শাজারাতুজ জাহাব: ৯/৩৯৭-৩৯৯, দার ইব্ন কাসির, বৈরুত: ১৯৯৩)
তাঁর এসব রচনা জ্ঞানের এক অনন্য ভান্ডার, যা ইসলামি জ্ঞানপিপাসুদের পথপ্রদর্শক হিসেবে বিবেচিত। বিশেষ নুখবাতুল-ফিকার কিতাবটি এখনো উপমহাদেশের মাদ্রাসাগুলোতে পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত।রেখে যাওয়া উত্তরসূরি
ইবনে হাজার (রহ.) শুধু নিজেই একজন বড় আলেম হয়ে উঠেননি, তাঁর হাতে গড়ে উঠেছেন অনেক জ্ঞানী ছাত্র। এই ছাত্ররাই তাঁর শিক্ষা ও চিন্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন দিগ্বিদিক।
তাঁদের মধ্য থেকে যাঁরা সবচেয়ে পরিচিত: ইমাম সাখাভি, কাসিম বিন কুতলুবাগা, আবুল ফজল আল-মাক্কি, ইবনে হুমাম, ইবরাহিম আল বিকাঈ, ইবনে তাগরিবর্দি প্রমুখ। (ভূমিকা, তাহজিবুত তাহজিব: ১/৩৬, দারুল হাদিস, কায়রো: ২০১০)
জ্ঞানার্জনে তিনি রেখে গেছেন অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর। তাঁর গভীর জ্ঞানে মুগ্ধ হয়েছিলেন যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসরাও। ফলে অনেকেই অকপটে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন।
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) বলেন, ‘তিনি স্বীয় যুগের শাইখুল ইসলাম ও হাদিসবিশারদদের ইমাম; মিসরের প্রধান হাদিসবিশারদ; বরং বলা যায় পুরো বিশ্বের হাদিসবিশারদ ছিলেন তিনি।’ (ভূমিকা, তাহজিবুত তাহজিব: ১/৩৭, দারুল হাদিস, কায়রো: ২০১০)
আরেক প্রথিতযশা মুহাদ্দিস আল্লামা সাখাভি (রহ.) বলেন, ‘ইবনে হাজারের মৃত্যুর পর হাদিস বিশারদদের কেউই তাঁর সমকক্ষ হতে পারেননি।’ (ভূমিকা, তাহজিবুত তাহজিব: ১/৩৭, দারুল হাদিস, কায়রো: ২০১০)
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
৮৫২ হিজরির জিলহজ মাসে কায়রোতে ইন্তেকাল করেন হাফিজ ইবনে হাজার (রহ.)। তাঁর বয়স ছিল ৭৯ বছর। (ভূমিকা, তাহজিবুত তাহজিব: ১/৪৩, দারুল হাদিস, কায়রো: ২০১০)
তাঁর মৃত্যুতে শোকাভিভূত হয় পুরো কায়রো শহর। তবে তিনি মরেও অমর; তাঁর রেখে যাওয়া শিক্ষা ও লেখনী আজও আলোর পথের সন্ধান দিচ্ছে।
রায়হান আল ইমরান: লেখক ও গবেষক