আধুনিক সময়ে তাড়াহুড়োয় আমরা প্রায়ই নিজেদের যত্ন নিতে ভুলে যাই। দৈনন্দিন কাজের তালিকা সামলাতে গিয়ে, পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা নিজেদের শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক সুস্থতার দিকে নজর দিতে পারি না। তবে ইসলাম আমাদের এমন কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস শিখিয়েছে, যা শরীর, মন ও আত্মার সুস্থতা নিশ্চিত করে।
ইসলামের ১২টি স্বাস্থ্যকর অভ্যাস এবং তা বজায় রাখার উপায় তুলে ধরব, যা আমাদের জীবনকে আরও সুষম ও পরিপূর্ণ করতে সাহায্য করবে। এই অভ্যাসগুলোর শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উপকারিতা এবং কীভাবে তা দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করা যায়, তা নিয়েও আলোচনা করব।
শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চেয়ে উত্তম এবং আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়, যদিও উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে।
সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৬৬৪
স্বাস্থ্যকর অভ্যাসের তাৎপর্য
ইসলামে শরীর, মন ও আত্মার সুস্থতা একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চেয়ে উত্তম এবং আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়, যদিও উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৬৬৪)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য। আমাদের নিজেদের একটি গাছের সঙ্গে তুলনা করে দেখতে পারি, যাকে প্রতিদিন পানি, সূর্যালোক এবং যত্নের প্রয়োজন। এবার প্রতিদিন নিজেকে প্রশ্ন করি: ‘আমি কি আজ আমার শরীর, মন ও আত্মার জন্য কিছু করেছি?’
মনের জন্য স্বাস্থ্যকর অভ্যাস
মানসিক সুস্থতা আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইসলাম জ্ঞান অর্জন এবং সামাজিক সংযোগের ওপর জোর দেয়, যা মনকে সতেজ ও শক্তিশালী রাখে।
১. জার্নালিং
প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ এবং কৃতজ্ঞতার মুহূর্তগুলো লিখে রাখা মনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি নিজের অনুভূতি বিশ্লেষণ করতে এবং মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, জার্নালিং উদ্বেগ হ্রাস করে এবং মানসিক স্পষ্টতা বাড়ায়। (পেনেবেকার, ১৯৯৭, পৃ. ১৬২, সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স, ৮(৩): ১৬২-১৬৬)।
প্রতিদিন কিছুক্ষণ সময় নিয়ে দিনের ঘটনা এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা লিখুন।
২. জ্ঞানগত উদ্দীপনা
ইসলাম জ্ঞান অর্জনের ওপর জোর দেয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ফরজ।’ (সুনানে ইবন মাজাহ, হাদিস: ২২৪)
নতুন ভাষা শেখা বা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায়। নিয়মিত জ্ঞান অর্জন মনকে সক্রিয় রাখে এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে।
৩. সামাজিক সংযোগ
বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং ইতিবাচক সঙ্গ নির্বাচন করা মানসিক সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। ইসলামে সামাজিক গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘মুমিনের জন্য মুমিন এমন, যেমন একটি ইমারতের অংশবিশেষ, যা একে অপরকে শক্তিশালী করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,০২৬)
এমন বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান, যাঁদের সঙ্গ আপনার এবং উম্মাহর জন্য উপকারী।
নতুন ভাষা শেখা বা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায়। নিয়মিত জ্ঞান অর্জন মনকে সক্রিয় রাখে এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে।
শরীরের জন্য স্বাস্থ্যকর অভ্যাস
শারীরিক সুস্থতা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি সুস্থ শরীর ইবাদত ও দৈনন্দিন কাজে সক্রিয়তা বজায় রাখতে সহায়তা করে।
৪. প্রতিদিন হাঁটা
প্রতিদিন ২০-৩০ মিনিট হাঁটা শরীরকে সক্রিয় রাখে এবং হৃদ্রোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত হাঁটা রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে এবং শারীরিক সুস্থতা বাড়ায়। হাঁটাহাঁটি আধ্যাত্মিক সুস্থতার জন্যও সহায়ক, কারণ সুস্থ শরীর ইবাদতকে সহজ করে।
৫. স্ট্রেচিং
সকালে বা ঘুমের আগে স্ট্রেচিং শরীরের শক্ত ভাব দূর করে এবং নমনীয়তা বাড়ায়। এটি পেশির টান কমায় এবং মানসিক সতেজতা আনে। গবেষণা অনুযায়ী, নিয়মিত স্ট্রেচিং জয়েন্টের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
প্রতিদিন কিছুক্ষণ স্ট্রেচিং করুন।
৬. সময়মতো ঘুম
পর্যাপ্ত ঘুম শরীর ও মনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামে সময়মতো ঘুম এবং ফজরের নামাজের জন্য জাগ্রত হওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তিনটি জিনিসে বরকত দিয়েছেন: সকালের খাবার, সম্প্রদায় এবং ফজরের নামাজ।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ২৪,৩৮৮)
সময়মতো ঘুমের রুটিন ফজরের নামাজে সহায়তা করে এবং শরীরকে সুস্থ রাখে।
৭. সচেতন খাদ্যাভ্যাস
ইসলামে সুষম ও হালাল খাদ্য গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা পৃথিবীতে যা হালাল ও পবিত্র আছে, তা থেকে খাও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৬৮)
ফলমূল ও শাকসবজিসমৃদ্ধ খাদ্য শরীরের শক্তি বাড়ায় এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা উন্নত করে। উনাইসা পরামর্শ দেন, প্রতিদিন সচেতনভাবে খাদ্য গ্রহণ করুন।
৮. পর্যাপ্ত পানি পান
পানিশূন্যতা শরীরের কার্যকারিতা কমায় এবং ক্লান্তি সৃষ্টি করে। ইসলামে পরিচ্ছন্নতা ও পানির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত পানি পান মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ও শারীরিক সুস্থতা বাড়ায়।
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান নিশ্চিত করুন।
মুমিনের জন্য মুমিন এমন, যেমন একটি ইমারতের অংশবিশেষ, যা একে অপরকে শক্তিশালী করে।
সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,০২৬
আত্মার জন্য স্বাস্থ্যকর অভ্যাস
ইসলামে আধ্যাত্মিক সুস্থতা জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত এবং জিকির আত্মাকে শান্তি ও শক্তি প্রদান করে।
৯. সময়মতো নামাজ
নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ এবং আধ্যাত্মিক সুস্থতার মূল চাবিকাঠি। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই নামাজ মুমিনদের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে ফরজ করা হয়েছে।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ১০৩)
শয়তান প্রায়ই আমাদের নামাজ থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করে। উনাইসা বলেন, নামাজকে অগ্রাধিকার দেওয়া জীবনের সাফল্যের চাবিকাঠি।
১০. কোরআন তিলাওয়াত
কোরআন পড়া আত্মার জন্য শান্তির উৎস। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি কোরআন নাজিল করেছি, যা মুমিনদের জন্য শিফা ও রহমত।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৮২)
গবেষণায় দেখা গেছে, কোরআন তিলাওয়াত মানসিক চাপ কমায় এবং শান্তি প্রদান করে। তাই প্রতিদিন কোরআন পড়ার জন্য সময় বের করুন।
১১. জিকির
আল্লাহর জিকির হৃদয়কে শান্ত করে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘জিকিরের মাধ্যমে হৃদয় শান্তি লাভ করে’ (সুরা রাদ, আয়াত: ২৮)
ইসলামে সময়মতো ঘুম এবং ফজরের নামাজের জন্য জাগ্রত হওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জিকির করে, তার জন্য জান্নাতে একটি গাছ রোপণ করা হয়।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৩৪৬৪)
নিয়মিত জিকির জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখে।
১২. আল্লাহর ওপর ভরসা
আল্লাহর ওপর ভরসা জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শক্তি প্রদান করে। উনাইসা উল্লেখ করেছেন একটি দোয়া: ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি অলসতা, বার্ধক্য, পাপ, ঋণ, কবরের ফিতনা, কবরের শাস্তি, জাহান্নামের ফিতনা, জাহান্নামের শাস্তি, সম্পদের ফিতনার ক্ষতি, দারিদ্র্যের ফিতনা এবং দাজ্জালের ফিতনা থেকে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৮২৩)
এই দোয়া আমাদের আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতার গুরুত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়।
কীভাবে এসব অভ্যাস ধরে রাখবেন
নতুন অভ্যাস গড়ে তোলা সহজ নয়। ছোট থেকে শুরু করুন এবং ধীরে ধীরে অভ্যাস তৈরি করুন। প্রতিদিন ৫ মিনিট কোরআন পড়া বা ১০ মিনিট হাঁটার রুটিন শুরু করা যেতে পারে। নিয়মিততা বজায় রাখতে একটি রুটিন তৈরি করুন এবং নিজের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করুন। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে, নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কর্ম নির্ভর করে নিয়তের ওপর।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১)
তাই এই অভ্যাসগুলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য গ্রহণ করুন।
ইসলাম আমাদের শরীর, মন ও আত্মার সুস্থতার জন্য একটি সামগ্রিক জীবনধারা শিক্ষা দেয়। ১২টি স্বাস্থ্যকর অভ্যাস আমাদের জীবনকে আরও সুষম ও পরিপূর্ণ করতে পারে। প্রতিদিন নিজেকে প্রশ্ন করুন: ‘আমি কি আজ আমার শরীর, মন এবং আত্মার জন্য কিছু করেছি?’