১৯৭২ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে প্রয়াত হন হিন্দি সিনেমার ‘ট্র্যাজেডি কুইন’ মীনা কুমারী। জন্মেছিলেন মেহজাবীন বানু নামে, অল্প বয়স থেকেই ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হয় তাঁকে—নিজের পছন্দে নয়, বাবার সিদ্ধান্তে। বাবার চোখে তিনি ছিলেন পরিবারের অর্থের উৎস। আজ এই অভিনেত্রীর জন্মদিন। এ উপলক্ষে আলো ফেলা যাক তাঁর জীবনে। মাত্র চার বছর বয়সে সিনেমার সেটে পা রাখা মীনার জীবনের শুরুটিই ছিল এক দীর্ঘ বঞ্চনার যাত্রা। তাঁর বাবা আলী বক্স, যিনি ছিলেন একসময়ের সংগীতশিল্পী, মুম্বাইয়ের (তৎকালীন বোম্বে) দাদারে একটি চাওল ঘরে পরিবার নিয়ে থাকতেন। তাঁর প্রথম স্ত্রী ও তিন সন্তানকে পাকিস্তানে রেখে ভারতে এসে তিনি বিয়ে করেন ইকবাল বেগমকে, যিনি আগে ছিলেন হিন্দু, নাম ছিল প্রভাবতী। এই দম্পতির তিন মেয়ে—খুরশীদ, মীনা ও মধু।
খুরশীদ যখন শিশুশিল্পী হিসেবে আয় করছেন, তখন আলী বক্স আরও দুই মেয়েকেও সিনেমায় কাজে লাগানোর লক্ষ্যে স্টুডিও থেকে স্টুডিওতে নিয়ে যেতে থাকেন। মীনা যখন জন্মান, তখন তাঁর জন্মে বাবার অনাগ্রহ এতটাই ছিল যে কথিত আছে, তিনি তাঁকে এতিমখানার সামনে ফেলে দিয়ে এসেছিলেন, যদিও সে তথ্য প্রমাণিত হয়নি। তবে তাঁদের বাসা ছিল এক এতিমখানার পাশেই, হয়তো সেখান থেকেই গুজবের উৎপত্তি।
‘শৈশবকে বিদায়’
বিনোদ মেহতার লেখা ‘মীনা কুমারী: দ্য ক্ল্যাসিক বায়োগ্রাফি’ বইয়ে মীনা কুমারীর একটি উক্তি উদ্ধৃত করা হয়, যেখানে তিনি বলেন, ‘যেদিন প্রথম কাজে গিয়েছিলাম, ভাবতেও পারিনি আমি শৈশবকে বিদায় জানাচ্ছি। মনে করেছিলাম, কয়েক দিন শুটিং করে স্কুলে যাব, পড়াশোনা করব, বন্ধুদের সঙ্গে খেলব। কিন্তু তা আর হয়নি।’
আলী বক্স বিশ্বাস করতেন, মেয়েদের স্কুলে পাঠানো বাড়তি খরচ। তাই তিন মেয়েকেই শিশুশিল্পী হিসেবে কাজে লাগান। প্রথম ছবি ‘লেদার ফেস’ থেকে মীনা পান ২৫ রুপি পারিশ্রমিক। তখনই আলী বুঝে ফেলেন, এই মেয়েই পরিবারের রোজগারের মূল উৎস হবে। বিনোদ মেহতা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মীনা কেবল পরিবারের “খাবারের টিকিট” হয়ে উঠেছিলেন। ৬-৭ বছর বয়স থেকেই তাঁকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাজ করানো হতো, আর সেই টাকায় চলত পুরো সংসার।’
তিন মেয়ের উপার্জনে পরিবার উঠে আসে দাদারের বস্তি থেকে বান্দ্রার চ্যাপেল রোডের একটি বাড়িতে, যা কিনা পরবর্তী সময় মীনার নামে কেনা হয়েছিল। ইকবাল বেগম ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে নাচ ছাড়েন, আর আলী বক্সও সংগীত ছেড়ে মেয়েদের ক্যারিয়ার নিয়ন্ত্রণে মন দেন।
ভালোবাসার নামে নিয়ন্ত্রণ, মেয়ের উপার্জনে সংসার, অথচ সিদ্ধান্তের অধিকার নেই
আলী ও ইকবালের দাম্পত্যে ভালোবাসা থাকলেও চরম দারিদ্র্য তা মুছে দেয়। মেহতার বই অনুযায়ী, তাঁদের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল কাগজে-কলমে, বাস্তবে নয়। সব সময় মেয়েদের সামনে অর্থ নিয়ে ঝগড়া চলত। শৈশবেই মীনা বুঝে গিয়েছিলেন, টাকা আয় করতে না পারলে তাঁর অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।
তিনি পড়াশোনা করতে চাইতেন, কিন্তু তাঁর সুযোগ মেলেনি। কিছু প্রাইভেট টিউটরের সাহায্যে পড়তে শেখেন, আর অবসর পেলেই বই নিয়ে এক কোণে বসে পড়তেন। তাঁর নিজের ভাষায়,‘স্টুডিওর অন্য শিশুরা যখন বাইরে খেলত, আমি কোণে বসে শিশুদের বইয়ের জগতে হারিয়ে যেতাম।’ সিনেমার নায়িকা হয়ে ওঠা
‘এক হি ভুল’, ‘পূজা’সহ একাধিক ছবিতে অভিনয় করেন, শুরু করেন গান গাওয়াও। ১৯৪১ সালে ‘বেহেন’ ছবিতে গেয়েছিলেন প্রথম গান। ছোটবেলা থেকেই আজ্ঞাবহ অভিনেত্রী হয়ে উঠলেও মাঝেমধ্যে আসল শিশুসত্তা মাথাচাড়া দিত। একবার যখন চরিত্র অনুযায়ী মরে যাওয়ার অভিনয় করতে বলা হয়, তিনি জোর করে বাধা দেন, আর তাঁকে জোর করে মাটিতে ফেলা হয়।
পরবর্তী সময়ে যখন বড় বোন বিয়ে করে অভিনয় ছাড়েন, তখন মীনা নিজেই নায়িকা, কিন্তু তখনো তিনি ছিলেন শুধুই পরিবারের উপার্জনের যন্ত্র। প্রথমবার স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেন যখন পরিচালক কামাল আমরোহীর সঙ্গে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। জানতেন বাবা রাজি হবেন না, তাই গোপনে বিয়ে করেন। পরে বাবাকে রাজি করাতে দেন দুই লাখ রুপি।
তবু আলী বক্স রাজি হন না। মীনা কিছুদিন বাবার বাড়িতেই থাকেন। কারণ, তিনিই তখন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। কিন্তু একদিন কামাল আমরোহীর একটি ছবিতে কাজ করতে সম্মত হন, আর বাবা যিনি আরেকটি প্রস্তাব এনেছিলেন, তা প্রত্যাখ্যান করায় মীনাকে তাঁর নিজের কেনা বাড়ি থেকেই বের করে দেওয়া হয়।
মেহতার বই অনুযায়ী, মীনা তখন চিঠিতে বাবাকে লেখেন,‘বাবুজি, যা হওয়ার হয়েছে। আদালতে যাওয়ার কথা বলবেন না, ওটা শিশুসুলভ। আপনার ঘর থেকে আমি কিছু চাই না, শুধু আমার জামাকাপড় আর বইগুলো চাই। গাড়িটা আমি কালই পাঠিয়ে দেব। আপনার সুবিধামতো আমার বাকি জিনিসপত্র পাঠিয়ে দেবেন।’