মানব জনমে সকল মনুষ্য সন্তান কিংবা জাতির সুখের মূলে সুস্বাস্থ্য এবং সুস্থতাই অগ্রগণ্য। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী না হলে, অঢেল ধন-সম্পদেও সুখী হওয়া যায় না।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশে সুনিশ্চিত চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তি একজন নাগরিকের প্রধানতম মৌলিক অধিকার। স্বাস্থ্য সেবা খাত প্রতিটি দেশের উন্নয়ন ও মানুষের জীবনমানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা শুধু মানুষের সুস্বাস্থ্যই নিশ্চিত করে না বরং সেদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি হতদরিদ্র ও জনবহুল-উন্নয়নশীল দেশে আধুনিক বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ।
সরকারি বেসরকারি সেক্টরের নানা অর্জন, ব্যর্থতা, সমস্যা, সম্ভাবনা, প্রচেষ্টা পরিবর্ধনের মাধ্যমে দেশের চিকিৎসা খাতের আমূল পরিবর্তন ও মানোন্নয়ন হলেও এখনো রয়ে গেছে জটিল কিছু সমস্যা। তবে সমস্যাগুলো জটিল হলেও সমাধান সম্ভব নয়; এমনটিও নয়।
চিকিৎসা পেশা যেখানে সবচেয়ে মানবিক পেশা হওয়ার কথা, সেখানে বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ গোটা বাংলাদেশে কিছু স্বার্থপরায়ন মানুষ এটিকে বাণিজ্যের শ্রেষ্ঠ ক্ষেত্র বানিয়ে তুলেছে। চিকিৎসকদের দায়িত্ববোধ, সরকারি নজরদারি, জনগণের সচেতনতা এবং কঠোর নীতিমালা প্রয়োগের অভাবে একরকম মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশীয় বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থা।
একজন অসুস্থ্য, মূমুর্ষ রোগী, মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের জীবনের শেষ আশ্রয়স্থল যেন আজ কারও কারো কাছে শোষণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত বিশাল বাজেট ও অবকাঠামোর দিক থেকে কচ্ছপ গতিতে হলেও ঈর্ষণীয় সফলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকারি – বেসরকারি উদ্যোগে এ দেশেই বেশ কিছু হাসপাতালে আধুনিক মানের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে সেটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফলে, সাধারণ মানুষ বিশেষ করে দরিদ্র ও অসহায় রোগীদের আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসা পাওয়া যেন এখন ভাগ্যের বিষয়।
বিশেষজ্ঞ মহলের দাবি, চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমাদের নিজস্ব সৃষ্ট কিছু কৃত্রিম সমস্যা যেমন, অব্যবস্থাপনা, সরকারি হাসপাতালে নিয়োজিত চিকিৎসকদের দায়িত্বে অবহেলা এবং বহিরাগত সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক ভয়াবহ অবস্থা। সরকারি হাসপাতালগুলোতে কর্মরত অনেক চিকিৎসক নির্ধারিত সময়েও হাসপাতালে উপস্থিত থাকেন না। সরকারি নানা সমস্যার কারণে চিকিৎসক সংকট জেনেও সরকারি বেতন গ্রহণ করে হাসপাতালের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা একটি গুরুতর পেশাগত অনৈতিকতা। আবার কেউ কেউ হাসপাতালে উপস্থিত হলেও রোগীদের সঙ্গে দায়িত্বশীল আচরণ না করে তাড়াহুড়ো করে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেন। বাড়তি আয়ের উদ্দেশ্যে দিনের ব্যস্ততম বহু চিকিৎসক প্রাইভেট চেম্বার বা ক্লিনিকে মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিকে রোগী দেখেন—যেখানে সাধারণ রোগীদের সেই চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য থাকে না।
এসব বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবায়ন নেই। আইনগত তদারকি অনুপস্থিত, অন্যদিকে রোগী অধিকার বিষয়ে জনসাধারণের সচেতনতা বিপুলভাবে কম।
পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায, সরকারি হাসপাতালের মর্গ থেকে মৃতদেহ নেওয়ার সময় স্বজনদের কাছ থেকে অনৈতিকভাবে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। এমনকি, কখনো কখনো অভিযোগ পাওয়া যায় যে, চিকিৎসা অবহেলা বা ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে, অথচ দায় এড়াতে দ্রুত লাশ হস্তান্তরের চাপ দেওয়া হয়। লাশ রাখার ঘরেও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ রয়েছে, যেখানে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য ভয়াবহ।
সরকারি হাসপাতালের গেট, জরুরি বিভাগ কিংবা মর্গ—প্রতিটি জায়গায় সক্রিয় এম্বুলেন্স সিন্ডিকেট। মাত্র কয়েক কিলোমিটারের যাত্রা পথেও ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয়। কোনো রোগী মৃত্যুবরণ করলে সেই মৃতদেহ বহনের জন্যও দরদাম চলে লাশের ওপর। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে কোনো কোনো হাসপাতাল কর্মচারী জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। রোগীর স্বজনরা এমন সংকটময় মুহূর্তে প্রতিবাদ করার সাহস পান না, বাধ্য হয়ে টাকা দিয়েই সেবা নিতে হয়। লাশ বাণিজ্যে মৃত্যুর পরও শেষ রেহাই নেই।
সরকারি হাসপাতালে সরবরাহকৃত ওষুধের বড় একটি অংশ নির্দিষ্ট কিছু ফার্মেসিতে পাচার হয় বলে বহু রোগীই অভিযোগ করেন। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে দেওয়া টেস্ট বা রিপোর্ট ‘মেশিন নষ্ট’ বা ‘স্টাফ নেই’ বলে ফিরিয়ে দিয়ে বাইরে রেফার করে দেওয়া হয়, যার পেছনে থাকে কমিশনভিত্তিক চুক্তি।
হাসপাতালের প্রতিটি সেক্টরে দালাল চক্রের প্রভাব রয়েছে—ভর্তি, অপারেশন, টেস্ট, এমনকি মৃত্যুজনিত কার্যক্রমেও। দালালরা রোগীর স্বজনদের প্রভাবিত করে প্রাইভেট ক্লিনিক বা নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিকে পাঠান, যার বিনিময়ে ডাক্তার ও সংশ্লিষ্টরা আর্থিক সুবিধা পান।
স্বত্ববিহীন সব দুর্নীতির মধ্যেও আশা ও সম্ভাবনাময় কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ গড়ে উঠেছে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো গ্রামীণ জনগণের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ভূমিকা রাখছে। স্বাস্থ বাতায়নের (১৬২৬৩) হটলাইনের মাধ্যমে টেলি-চিকিৎসা সেবা সহজ হয়েছে।কিছু বেসরকারি সংস্থা স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে গরিবদের পাশে দাঁড়াচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্যখাতকে টিকিয়ে রাখতে এ সমস্যা থেকে উত্তরণে দ্রুত সময়ের মধ্যে ফলপ্রসু ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে উঠেছে।
যেমন, চিকিৎসকদের সরকারি দায়িত্ব পালনে কঠোর মনিটরিং ও উপস্থিতি ট্র্যাকিং, সরকারি ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সময় নির্ধারণ ও সরকারি সময়ের মধ্যে তা নিষিদ্ধ করা, এম্বুলেন্স ও লাশ পরিবহন খাতে রেজিস্ট্রারভুক্ত সেবার আওতায় আনা, দালাল ও ওষুধ সিন্ডিকেট নির্মূলে সিসিটিভি মনিটরিং ও নিয়মিত অভিযানে টাস্কফোর্স গঠন, হাসপাতালে একটি “রোগী অভিযোগ সেল” চালু রাখা, যার মাধ্যমে ভুক্তভোগীরা সরাসরি অভিযোগ জানাতে পারবেন। সেই সাথে সাথে চিকিৎসা পেশায় গুণগত মান নিশ্চিত করা খুব জরুরি। না হলে স্বাধীনভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থায় মৃত্যুর হার আর বাড়বে।
চিকিৎসা পেশা জানতে হবে—এটি সেবা নয়, এটি জীবন সহযোগিতা। নৈতিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে, রোগীকে মর্যাদা দিতে হবে, ও দায়িত্বহীনতা নির্মূলে কার্যকর প্রচেষ্টা গড়ে তুলতে হবে। পরিবার ও রোগীকে শ্রদ্ধা সহকারে সেবা দেওয়া, ন্যায়সঙ্গত তদন্ত নিশ্চিত করা, শরিয়াহগত সঠিক নিরীক্ষা ও শক্তিশালী আইন কার্যকর করলে স্বাস্থ্য বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব।