টাঙ্গাইলে মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ কলেজের গভর্নিংবডি কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলামকে সরিয়ে ওই পদে বসতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন জেলা বিএনপির সভাপতি হাসানুজ্জামীল শাহীন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক মনোনীত অধ্যাপক নজরুল ইসলাম যাতে কোন কার্যক্রমে অংশ নিতে না পারে এজন্য কলেজের অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলামকে চাপ দিয়েছেন বলেও জানা গেছে। এমন অবস্থায় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার কথা জানিয়েছেন অধ্যক্ষ আমিনুল। এরমধ্যে শাহীনের হুমকিতে পরিবর্তন করা হয়েছে নতুন কমিটির সভার তারিখও।
জানা যায়, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা সকল বেসরকারি কলেজ পরিচালনার জন্য অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গঠনে স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ ও সমাজের শিক্ষিত, দক্ষ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেয়া হয়। সে হিসেবে মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ কলেজের গভর্নিংবডি কমিটির সভাপতি হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলামকে মনোনীত করা হয়।
এরপর গভর্নিংবডি গঠনের জন্য অভিভাবক প্রতিনিধি, শিক্ষক প্রতিনিধি, হিতৈষী সদস্য, দাতা সদস্য ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নির্বাচনের লক্ষ্যে গত ৩০ এপ্রিল তফসিল ঘোষণা করা হয়। ১৮ মে কলেজ প্রাঙ্গণে ভোটারদের ভোট গ্রহণ করা হয়। গত ২৩ জুন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক আব্দুল হাই সিদ্দিক সরকার অধ্যাপক মুহম্মদ নজরুল ইসলামকে সভাপতি ও টাঙ্গাইল জেলার পিপি শফিকুল ইসলাম রিপনকে বিদ্যোৎসাহী সদস্য মনোনীত করে কলেজের অধ্যক্ষ বরার চিঠি দেন।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সভাপতি হাসানুজ্জামিল শাহীন অনেকদিন ধরেই ওই কলেজের সভাপতি হতে চেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু সভাপতি পদ না পেয়ে শাহীন সাহেব ক্ষিপ্ত হন এবং নানা অপকৌশল প্রয়োগ করে বিভিন্ন মাধ্যমে আমাকে হুমকি দিয়ে আসছেন। তার এই হুমকি উপেক্ষা করে আমি শিক্ষকসহ অন্যান্য সকলের সহযোগিতা নিয়ে কলেজের কার্যক্রম চালিয়ে আসছি। গত ১৭ জুলাই নতুন কমিটির প্রথম সভা আহ্বান করলে শাহীন সাহেব অধ্যক্ষকে হুমকি দিয়ে সভা স্থগিতের কথা বলেন এবং অন্যান্য সদস্যদেরকেও ফোন করে সভায় অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করেন। এক পর্যায়ে সদস্যদের অনুরোধে সভার তারিখ ২৪ জুলাই পুনঃনির্ধারণ করি। এইবার শাহীন সাহেব সভার চিঠি ইস্যু না করার জন্য অধ্যক্ষকে হুমকি ধমকি দেন এবং জীবননাশের ভয় দেখান। অধ্যক্ষ তার জীবননাশের শঙ্কার কথা ফোন করে আমাকে জানান এবং সভার চিঠি ইস্যু করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।’
এ সংক্রান্ত একটি কল রেকর্ডও হাতে এসেছে। সেখানে নজরুল ইসলামকে উদ্দেশ্য করে কলেজের অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলামকে বলতে শুনা যায়, ‘এতকিছু শুইনা কি করবেন আপনে স্যার। আপনিতো আমার নিরাপত্তা দিতে পারবেন না। আপনি কি আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারবেন? আপনি দূরের মানুষ। দেশে কতকিছু হইতাছে, কত মব সৃষ্টি হইতাছে। বিচার দেওয়ার জায়গা কোথায়, বলেন? আপনি ঝুঁকি নিতে বলতেছেন কেন? একটু বুইঝা শুইনা অপেক্ষা করেন। আপনি জিডি করতে বলতেছেন। আমি জিডি কইরা ক্ষেপাবো নাকি, গণপিটুনি খাব আমি? আমি অপারগতা প্রকাশ করছি। আমি মিটিং ডাকতে পারব না। আপনে ডাকেন স্যার। আমার সব দায়িত্ব আপনি দূর থেকে নিতে পারবেন না। আপনি অনেক বড় মানুষ, আমি ক্ষুদ্র মানুষ। আমার জীবন আগে। তারপর অন্যকিছু।’
কলেজের এমন অবস্থা কাম্য নয় জানিয়ে টাঙ্গাইল জেলার পিপি ও কলেজের বিদ্যোৎসাহী সদস্য শফিকুল ইসলাম রিপন বলেন, ‘যোগ্যতা ও দক্ষতা বিবেচনা করলে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এগিয়ে থাকবেন। তিনি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। শিক্ষার মান উন্নয়নে তিনি জোরালো ভূমিকা রাখতে পারবেন বলেই মনে করি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সেটা বিবেচনা করেই তাকে সভাপতি হিসেবে মনোনীত করেছে। কিন্তু কলেজের দুই-তিনজন শিক্ষক নজরুল ইসলামকে মেনে নিতে পারতেছে না। এদিকে বিএনপির সভাপতি হাসানুজ্জামিল শাহীনও সভাপতি হওয়ার চেষ্টা করতেছে। এভাবে চলতে থাকলে কলেজের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। বিষয়টি সমাধানে আমি জেলার বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তির সাথে কথা বলেছি। আশা করছি দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে।’
এ ব্যাপারে মাহদুল হাসান কলেজের অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘অধ্যাপক নজরুল ইসলামকে নিয়ে আমার কাজ করতে কোন সমস্যা নেই। তিনি স্থায়ী হওয়ার আগে নয় মাস কাজ করেছি, কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু তৃতীয় পক্ষ বাইরে নানা কথা বলে সঙ্কট জটিল করতেছে। আর নজরুল ইসলাম যথেষ্ট যোগ্য একজন লোক। এখন একজন সভাপতি হতে চাইতেই পারেন। আমি তো ঠেকাতে পারব না। আবার কাউকে সভাপতি বানানোর ক্ষমতাও আমার নাই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সেটা ঠিক করেছে কে সভাপতি হবেন। সেখান থেকে যাকে দেওয়া হয়েছে তার সাথেই আমার কাজ করতে হবে। কলেজ যাতে ভালোভাবে চলে আমার সেটা দেখতে হবে। কলেজের দাতা সদস্য ও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যারা আছেন তাদেরও কোন আপত্তি নেই অধ্যাপক নজরুল ইসলামকে নিয়ে।’
নিরাপত্তাহীনতায় ভুগার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওইরকম কোন সমস্যা এখন নেই। মানুষ বাইরে অনেক কথা বলে। আমি চাই কলেজ ভালোভাবে চলুক।’
আর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই জেলা বিএনপির সভাপতি ও কলেজের গভর্নিংবডির সভাপতি প্রার্থী হাসানুজ্জামীল শাহীনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক নুরুল ইসলাম জানান, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আমরা কলেজগুলোর শিক্ষার মান বাড়াতে মনোযোগ দিয়েছি। এজন্য আগের মতো রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রাধান্য পাননি। আমরা শিক্ষাবিদ, সমাজের শিক্ষিত ও দক্ষ ব্যক্তিদের প্রাধান্য দিয়ে কমিটি গঠনের চেষ্টা করেছি। যাদের নাম আমাদের কাছে এসেছে সেখান থেকে যোগ্যদেরই আমরা মনোনীত করার চেষ্টা করেছি। সামনের দিনেও এ চেষ্টা অব্যহত থাকবে।