বর্তমান যুগকে বলা হয় তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। আমরা চাই আধুনিক হতে, স্মার্ট হতে, সবকিছুতে এগিয়ে থাকতে। স্মার্টনেস এখন শুধু পোশাকে বা কথাবার্তায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং জীবনযাপন, চিন্তা-ভাবনা, এমনকি নীতিনৈতিকতার ক্ষেত্রেও আমরা স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই স্মার্ট হওয়ার পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা কি আমাদের আদর্শ, মূল্যবোধ, এবং মানবিক গুণাবলি হারিয়ে ফেলছি না?
আগে মানুষ কেমন ছিল? পরিবার ছিল একটি প্রতিষ্ঠানের মতো, যেখানে বড়রা ছোটদের শিখাত, মূল্যবোধ গঠনে সাহায্য করত। সবাই মিলে খাওয়া, গল্প করা, পরামর্শ নেওয়া ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এখনকার চিত্র একদম আলাদা। সবাই ব্যস্ত, সবাই নিজের মতো। স্মার্ট ফোন, স্মার্ট টিভি, স্মার্ট ওয়ার্ক, সব কিছুতেই আমরা যত বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হচ্ছি, ততই যেন সম্পর্কগুলো মলিন হয়ে যাচ্ছে।
একটা সময় ছিল, যখন মানুষ সত্য বলাকে গর্ব মনে করত, অন্যায়ের প্রতিবাদ করত, দুর্বলকে সাহায্য করত। এখন আমরা বলি, “স্মার্ট মানুষ কখনো আবেগে চলে না, বুদ্ধিতে চলে।” কিন্তু এই বুদ্ধি প্রয়োগ করতে গিয়ে আমরা কি মানবিকতা ভুলে যাচ্ছি না? কেউ কষ্টে থাকলেও বলি, “ওর সমস্যা ওর নিজের,” অথচ আগে প্রতিবেশীর দুঃখেও মানুষ নিজেকে দায়ী ভাবত।
শিক্ষা ব্যবস্থায়ও এর প্রভাব পড়েছে। আগে শিক্ষার্থীদের শেখানো হতো কেবল পাঠ্যবই নয়, জীবনের পাঠ। এখন পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেলেই স্মার্ট, কেউ যদি বেশি প্রশ্ন করে বা গভীরভাবে চিন্তা করে, তাকে বলে ‘অতিরিক্ত সিরিয়াস’। শিক্ষকদের সম্মান আগের মতো নেই, কারণ আমরা বলি, “ইন্টারনেটে সব আছে, টিচারের দরকার কী?”
স্মার্ট হতে গিয়ে আমরা অহংকারী হয়ে যাচ্ছি। আমরা ভাবি, আমরা সবার চেয়ে বেশি জানি। কিন্তু জ্ঞানের সঙ্গে বিনয় না থাকলে, সেই জ্ঞান সমাজের উপকারে আসে না। আগে মানুষ নীরবে উপকার করত, এখন ছবি তুলে ফেসবুকে দেয়, যাতে সবাই জানে – “দেখো, আমি কতটা মানবিক।” এই লোক দেখানো মানবিকতা আসলে আত্মপ্রচারের অংশ, আদর্শের নয়।
মানুষ আগে যেসব গুণকে জীবনের মূল হিসেবে মানত – যেমন সততা, পরিশ্রম, ধৈর্য, নম্রতা – এখন সেগুলোকে অনেকেই দুর্বলতা ভাবে। এখন যদি কেউ খুব বেশি সত্যবাদী হয়, তাকে বলা হয় “পিছিয়ে আছে”। অথচ, এই গুণগুলোর উপর ভর করেই সমাজে সুস্থ সম্পর্ক তৈরি হয়, বিশ্বাস তৈরি হয়, শান্তি আসে।
আমরা আধুনিক হব, এটা অবশ্যই দরকার। স্মার্ট প্রযুক্তি আমাদের কাজকে সহজ করছে, জীবনকে গতিশীল করছে। কিন্তু সমস্যা হলো, যখন এই স্মার্টনেস আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে চাপা দেয়, তখনই বিপদ। মানুষ যন্ত্র না, মানুষের আবেগ আছে, মূল্যবোধ আছে। যদি আমরা শুধু মেশিনের মতো চিন্তা করি, তাহলে মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য থাকবে কোথায়?
আমাদের সমাজে আজকাল দেখা যায়, ন্যায়-অন্যায় নিয়ে অনেকেই ভাবে না। কেউ যদি অন্যায় করে পার পেয়ে যায়, তখন আমরা বলি, “ও খুব স্মার্ট!” কিন্তু আদর্শ মানুষ সেই, যে অন্যায়কে না বলে, সত্যকে গ্রহণ করে। এই সত্যকে আঁকড়ে ধরার লোক আজ কমে যাচ্ছে।
স্মার্ট হওয়া ভালো, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আদর্শ হারিয়ে ফেলব। আমাদের উচিত স্মার্ট প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে আরও মানবিক হওয়া, আরও সৎ হওয়া। প্রযুক্তি হোক আমাদের সহায়ক, কিন্তু নীতিহীনতার বাহন না। স্মার্টনেস যেন আমাদের আদর্শকে ঢেকে না ফেলে, বরং আদর্শকে আরও জ্বলজ্বলে করে তোলে— এটাই হওয়া উচিত আমাদের লক্ষ্য।