ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি শিক্ষা বিভাগের ছাত্র রুহুল আমিন। প্রথম পরিচয়ে হয়তো তাঁকে সাধারণ মনে হতে পারে, কিন্তু তাঁর জীবনের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে আছে এক অসাধারণ সংগ্রামের গল্প। একটি গল্প যেখানে অভাব, সীমাবদ্ধতা আর স্বপ্ন একসঙ্গে হাত ধরে এগিয়ে চলে প্রযুক্তির জগতের এক সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে। এখন নিজে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান দিয়েছেন। এই সফল উদ্যোক্তার উদ্যোগে কাজ করেন ১৫ জন।
রুহুল আমিনের গ্রাম কাজীশাল, মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায়। বাবার নাম হাফেজ আবু দাউদ শিকদার, পেশায় একজন ইমাম, মা রাশিদা বেগম। তিন ভাইয়ের মধ্যে রুহুল আমিন দ্বিতীয়। এখন তিনি থাকেন ঢাকার সবুজবাগের মান্ডায়।
রুহুলের শিকড় মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থায়, ইসলামপুর কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করেন ২০১৫ সালে। যেখানে তিনি এ প্লাসসহ চমৎকার ফল অর্জন করেন। ২০১৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় তাঁর পরিবারকে নিতে হয় ঋণ, আর এখান থেকেই শুরু হয় এক নতুন জীবন সংগ্রাম। সব সময় মাথায় ঘুরত কীভাবে এই ঋণ শোধ করবেন। কীভাবে পরিবারের হাল ধরা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে টিউশনি করার আশা ছিল, কিন্তু বিষয় হিসেবে ইসলামি শিক্ষা হওয়ায় তেমন সুযোগ মিলছিল না। আর্থিক সংকট, সামাজিক চাপে খানিকটা গুটিয়ে থাকা স্বভাব—সব মিলিয়ে একধরনের অসহায়ত্ব এসে ঘিরে ধরে তাঁকে।
এর আগে ২০১৩ সালের দিকেই তাঁর প্রযুক্তিজগতে প্রথম পা রাখা। বড় ভাই ছিলেন একজন গ্রাফিক ডিজাইনার, আর তাঁর হাত ধরেই রুহুলের প্রথম পরিচয় হয় ডিজাইন ও কম্পিউটারের সঙ্গে। এরপর ধীরে ধীরে জড়ান ফ্রিল্যান্সিংয়ে, যদিও শুরুটা ছিল খুবই কষ্টকর। ল্যাপটপ কেনার জন্য বাড়ি থেকে ঋণ নিতে হয়। ১৬ হাজার টাকা দিয়ে একটা পুরোনো ল্যাপটপ কেনেন।
প্রথম দিকের কাজগুলোর মধ্যে ছিল ওয়ার্ড ফাইলে টাইপ করা, ই–মেইল পাঠানো, সেই কাজের পারশ্রমিক ছিল মাত্র ১ ডলার। কিন্তু ছোট ছোট এই কাজগুলোই রুহুলকে আত্মবিশ্বাস দেয়। রুহুল তখন কাজ করতেন ফ্রিল্যান্সার ডটকমে। তিনি উপলব্ধি করেন, শুধু কাজ পেলে হবে না, কাজ জানাও লাগবে। তাই সিদ্ধান্ত নেন গ্রাফিক ডিজাইন নিয়ে কাজ করার। যদিও খুব দ্রুত বুঝে যান যে নকশা করার মতো সৃজনশীলতা (ক্রিয়েটিভিটি) তাঁর মধ্যে নেই।
তবু দমে যাননি রুহুল আমিন। শুক্রবার ক্রিয়েটিভ আইটির একটি ফ্রি সেমিনারে গিয়ে তিনি খুঁজে পান কমিউনিটি, খুঁজে পান অনুপ্রেরণা। সেই প্রতিষ্ঠানেই একটি বৃত্তি পান, যেখানে তিনি ইউআই/ইউএক্স ডিজাইন, ব্যানার, পোস্টার, ওয়েব ডিজাইন শেখেন। এক শিক্ষক তাঁকে পরামর্শ দেন প্রোগ্রামিংয়ে যাওয়ার। এরপরই যেন রুহুল নিজের সত্যিকারের জায়গা খুঁজে পান।
রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যখন কাজ পাচ্ছিলাম না কোথাও। তখন আমি একটা পোর্টফোলিও তৈরি করা শুরু করলাম। আমার আশপাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁদেরকে বলতাম, “ভাই, আপনার প্রতিষ্ঠানের একটা ওয়েবসাইট দরকার, আপনি শুধু ডোমেইন হোস্টিং কেনেন। আমি ওয়েবসাইট বিনা মূল্যে বানিয়ে দেব। এভাবে করে অনেক ওয়েবসাইট তৈরি করে ফেললাম। এরপরই আমার কাজ অনেকে দেখে যোগাযোগ করতে থাকেন।’
প্রথম বড় কাজ ছিল একটি ব্লাড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম তৈরি করা, যার জন্য ৪০ হাজার টাকার প্রকল্পে তাঁকে ৫ হাজার টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়। কাজটি করতে গিয়ে আটকে গেলে তিনি সাহায্য নেন শিক্ষকের কাছ থেকে এবং কাজ সফলভাবে শেষ করেন। এরপর ধীরে ধীরে আসতে থাকে আরও কাজ, আসে পরিচিত ব্যক্তিদের প্রজেক্ট, ক্লায়েন্টদের আস্থা।
রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৯ সালে স্নাতক (সম্মান) শেষ করি, কিন্তু তখনো চাকরিতে না গিয়ে নিজের দক্ষতাকে আরও পোক্ত করার সিদ্ধান্ত নেই। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা আমার কাজ দেখে বলে, “তুমি আইটি (তথ্যপ্রযুক্তি) প্রতিষ্ঠান দাও, আমরা বিনিয়োগ করব।” যেহেতু বড় ভাইয়েরা অনেক ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে আছেন এবং নিজেদের ব্যবসাও আছে। আর আমারও ইচ্ছা একটা নিজের প্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন, আমি রাজি হয়ে গেলাম। শুরু করলাম নিজের প্রতিষ্ঠান ইনোভা। আর আমি হলাম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকতা।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইদের সহযোগিতায় গড়ে তোলেন একটি দল, বাসা ভাড়া করে শুরু করেন ঘরোয়া অফিস থেকে কাজ। ধীরে ধীরে সেই দল একটি পূর্ণাঙ্গ আইটি প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়, যার অফিস এখন ঢাকায়। রুহুল আমিনের প্রতিষ্ঠান ভিডিও প্রোডাকশন থেকে শুরু করে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, কনটেন্ট মার্কেটিং—বহু সেবা দিচ্ছে এখন।
তাঁর প্রতিষ্ঠান আজ যে জায়গায় পৌঁছেছে, তা শুধু আয়ের দিক থেকে নয়, বরং সমাজে আত্মপ্রত্যয় ও উদ্যমের অনুপ্রেরণা হিসেবেও কাজ করছে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ১৫ জন। সামনে আরও বেশি কর্মসংস্থান করার উদ্যেগ রয়েছে রুহুল আমিনের।