‘সুন্দর জীবন’—এমন একটি জীবন, যা দুশ্চিন্তা, কষ্ট, সমস্যা ও প্রতিকূলতা থেকে মুক্ত এবং আনন্দ, সুখ, নিয়ামত ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভরপুর। কে না চায়, এমন জীবন? আমরা সবাই আমাদের সাধ্যের মধ্যে সর্বোত্তম জীবনযাপনের জন্য চেষ্টা করি।
কিন্তু জীবনের চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও কীভাবে আমরা সত্যিকারের সুন্দর জীবন লাভ করতে পারি? কোরআন আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। ছয়টি শিক্ষার কথা বলছে কোরআন, যা আমাদের জীবনকে আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িকভাবে সুন্দর করে তুলতে পারে।
১. নেক আমল ও ইমান
কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি নেক আমল করে, পুরুষ হোক বা নারী, যদি সে ইমানদার হয়, তবে আমি অবশ্যই তাকে সুন্দর জীবন দান করব এবং আখিরাতে তাদেরকে তাদের সর্বোত্তম কাজের পুরস্কার দেব।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ৯৭)
এই আয়াতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে।
ক. দুনিয়াতে পুরস্কার: নেক আমল ও ইমানের ফল হিসেবে আল্লাহ দুনিয়াতেই ‘হায়াতুন তাইয়্যিবা’ বা সুন্দর জীবন দান করেন।
খ. নারী-পুরুষের সমতা: এই পুরস্কার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব ইমানদারের জন্য, যা কিছু পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে একটি শক্তিশালী বার্তা।
গ. আখিরাতে পুরস্কার: দুনিয়ার এই সুন্দর জীবন ছাড়াও আখিরাতে নেক আমলের ভিত্তিতে আরও উত্তম পুরস্কার অপেক্ষা করছে।
যে ব্যক্তি নেক আমল করে, পুরুষ হোক বা নারী, যদি সে ইমানদার হয়, তবে আমি অবশ্যই তাকে সুন্দর জীবন দান করব।
সুরা নাহল, আয়াত: ৯৭২. ফেরেশতাদের সুরক্ষা ও সাহায্য
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা বলে, “আমাদের রব আল্লাহ” এবং তারপর সঠিক পথে অটল থাকে, তাদের ওপর ফেরেশতারা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, “ভয় করো না, চিন্তা করো না, বরং জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো।’’’(সুরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৩০-৩১)
ফেরেশতারা ইমানদারদের জন্য এই দুনিয়াতে সুরক্ষা ও সাহায্যের দায়িত্ব পালন করেন। এই সাহায্য প্রায়ই অদৃশ্য হয়, যেমন কোনো কাজ সহজে সম্পন্ন হওয়া, বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া বা অপ্রত্যাশিতভাবে সমস্যার সমাধান হওয়া।
যেমন একজন ইমানদার যখন কোনো দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত থাকেন, যেমন কোথাও লাইনে দাঁড়িয়ে কিছু কেনা, তখন ফেরেশতাদের সাহায্যে তাঁর কাজ দ্রুত ও সহজে সম্পন্ন হয়। এই অদৃশ্য সাহায্য ইমানদারদের জীবনকে সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করে। হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষের জন্য ফেরেশতা নিয়োজিত আছে, যারা তাকে পাপ থেকে রক্ষা করে, যদি না তা তাকদিরে লিখিত হয়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং: ২৯৬৩)
৩. পাপের বোঝা থেকে মুক্তি
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের ওপর যে বিপদ আসে, তা তোমাদের নিজ হাতের কৃতকর্মের কারণে।’ (সুরা শুরা, আয়াত: ৩০)
পাপ ও অপরাধ জীবনে সমস্যা, বিলম্ব ও কষ্টের কারণ হয়। কিন্তু ইমানদারেরা নিয়মিত ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) ও তওবার মাধ্যমে তাঁদের পাপের বোঝা থেকে মুক্ত থাকেন। এটি তাঁদের হৃদয়কে হালকা করে এবং তাঁদের বিবেককে পরিচ্ছন্ন রাখে।
ইমানদারেরা ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে কষ্ট দেন না বা অবিচার করেন না, যা তাঁদের জীবনে শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আসে। ইবনে তাইমিয়া বলেন, ‘ইস্তিগফার হৃদয়ের ময়লা দূর করে এবং আল্লাহর রহমতের পথ উন্মুক্ত করে।’ (ইবনে তাইমিয়া, ১৯৯৫, মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়া, পৃষ্ঠা: ২৫০, দারুল ওয়াফা প্রকাশনী)
ফেরেশতারা ইমানদারদের জন্য এই দুনিয়াতে সুরক্ষা ও সাহায্যের দায়িত্ব পালন করেন। এই সাহায্য প্রায়ই অদৃশ্য হয়, যেমন কোনো কাজ সহজে সম্পন্ন হওয়া, বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া বা অপ্রত্যাশিতভাবে সমস্যার সমাধান হওয়া।
৪. হালাল রিজিকে বরকত
ইমানদারেরা শুধু হালাল উপায়ে রিজিক উপার্জন করেন। তাঁদের উপার্জন পরিমাণে কম হলেও আল্লাহ তাতে বরকত দান করেন। এই বরকত তাঁদের স্বাস্থ্য, শক্তি, স্মৃতিশক্তি, উৎপাদনশীলতা, পারিবারিক সম্প্রীতি ও সম্পদের দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধিতে প্রকাশ পায়।
কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যদি তারা তাওরাত, ইঞ্জিল ও তাদের প্রতি প্রতিপালকের নিকট থেকে অবতীর্ণ কিতাবের প্রতি অটল থাকত, তবে তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবী থেকে রিজিক দেওয়া হতো।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ৬৬)
হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হালাল উপায়ে রিজিক উপার্জন করে, তার সম্পদে আল্লাহ বরকত দান করেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,০৬৫)
এই বরকত ইমানদারদের জীবনকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে, যা বৈষয়িক সম্পদের বাইরে গিয়ে আধ্যাত্মিক তৃপ্তি প্রদান করে।
৫. দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি
ইমানদারেরা আল্লাহর পথে ত্যাগ স্বীকার করেন এবং নেক আমলের মাধ্যমে তাঁকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। এর ফলে আল্লাহ তাঁদের হৃদয়ে একটি অমূল্য সম্পদ দান করেন—দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি। এই অনাসক্তি তাঁদেরকে দুশ্চিন্তা, ভয়, প্রত্যাশা ও কষ্ট থেকে মুক্ত রাখে। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে আল্লাহর নির্ধারিত ফলাফলই ঘটবে এবং তাঁদের নিয়ত ও প্রচেষ্টার জন্য পুরস্কৃত হবেন।
এই মানসিক শান্তি তাঁদের জীবনকে সুন্দর করে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট।’ (সুরা তালাক, আয়াত: ৩)
এই অনাসক্তি ইমানদারদের হৃদয়ে শান্তি ও স্থিরতা আনে, যা তাঁদের জীবনকে আরও অর্থপূর্ণ করে।
যদি তারা তাওরাত, ইঞ্জিল ও তাদের প্রতি প্রতিপালকের নিকট থেকে অবতীর্ণ কিতাবের প্রতি অটল থাকত, তবে তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবী থেকে রিজিক দেওয়া হতো।
সুরা মায়িদা, আয়াত: ৬৬৬. নেক সঙ্গ ও মানুষের ভালোবাসা
আল্লাহ নেক আমলকারীদের জন্য মানুষের হৃদয়ে তাঁদের প্রতি বিশুদ্ধ ভালোবাসা সৃষ্টি করেন। এই ভালোবাসা অতিরঞ্জিত কিছু নয়, বরং একটি আন্তরিক শ্রদ্ধা, যা তাঁদের দৈনন্দিন কাজকে সহজ করে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ইমানদার যখন কোনো সেবা গ্রহণ করেন, তখন চিকিৎসক, কর্মচারী বা দোকানদার তাঁর প্রতি অতিরিক্ত যত্নশীল হন।
এ ছাড়া আল্লাহ ইমানদারদের নেক সঙ্গ দান করেন, এমন মানুষ যাঁরা নিষ্ঠাবান, নম্র ও সৎ। এই সঙ্গ তাঁদের ইমানকে শক্তিশালী করে এবং জীবনকে আধ্যাত্মিকভাবে সমৃদ্ধ করে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে ইমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো।’ (সুরা তওবা, আয়াত: ১১৯)
এই নেক সঙ্গ জান্নাতের একটি পূর্বাভাস, যা ইমানদারদের জীবনকে সুন্দর করে।
সার কথা
কোরআন আমাদের শেখায় যে সুন্দর জীবন কেবল বৈষয়িক সম্পদ বা গ্ল্যামারে নয়, বরং নেক আমল, ইমান, তওবা, হালাল রিজিক, অনাসক্তি ও নেক সঙ্গের মাধ্যমে অর্জিত হয়।
ফেরেশতাদের সাহায্য, পাপের বোঝা থেকে মুক্তি, রিজিকের বরকত, দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি এবং মানুষের ভালোবাসা ও নেক সঙ্গ—এই সবই ইমানদারদের জীবনকে সুন্দর করে। বাইরে থেকে তাঁদের জীবন সাধারণ মনে হলেও আল্লাহ তাঁদেরকে এমন নিয়ামত দান করেন, যা অন্যরা কামনা করেও পান না।
সূত্র: অ্যাবাউট ইসলাম ডট নেট