মৃত্যু মানুষের জীবনের একটি অনিবার্য সত্য। ইসলামি আইনে মৃতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা একই সঙ্গে মানবিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ।
সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্যান্য জরুরি অবস্থায় মৃতদের দেহ সৎকারের ক্ষেত্রে ইসলামি আইনে বিশেষ দিকনির্দেশনা রয়েছে। সম্মিলিত কবর, দ্রুত সৎকার, দেহ উত্তোলন, ময়নাতদন্ত, সমুদ্রে সমাধি এবং লিঙ্গ-সংবেদনশীল দেহ দাফন করার মতো কয়েকটি দিক তুলে ধরব।
মানবদেহের প্রতি সম্মান
কোরআনে মানুষকে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে (সুরা বাকারা, আয়াত: ৩০)। জীবিত হোক বা মৃত, মানবদেহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ইসলামের একটি মৌলিক নীতি।
কোরআনের সুরা মায়িদার ৩১ আয়াতে কাবিল ও হাবিলের কাহিনিতে এ সম্মানের গুরুত্ব ফুটে ওঠে। কাবিল তাঁর ভাই হাবিলকে হত্যার পর তাঁর দেহ কীভাবে সৎকার করতে হবে, তা জানতেন না। আল্লাহ তখন একটি কাক পাঠান, যে মাটি খুঁড়ে আরেকটি কাককে কবর দেয়। আল্লাহ এভাবেই কাবিলকে শিখিয়ে দেন, কীভাবে তাঁর ভাইয়ের দেহ সমাহিত করতে হবে।
এর আলোকে প্রাচীন মুসলিম ফকিহরা (আইনবিদ) যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অন্যান্য জরুরি পরিস্থিতিতে মৃতদেহের সৎকারের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম প্রণয়ন করেছেন।
ইসলামের ইতিহাসে মৃতদেহের তালিকা সংরক্ষণের একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে শত্রুপক্ষের ৭০ জন এবং মুসলিম পক্ষের ১৪ জন শহীদের পূর্ণ নাম সংরক্ষিত আছে
মৃতদেহের অনুসন্ধান ও সংগ্রহ
ইসলামের ইতিহাসে মৃতদেহের তালিকা সংরক্ষণের একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধে (৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ) শত্রুপক্ষের ৭০ জন এবং মুসলিম পক্ষের ১৪ জন শহীদের পূর্ণ নাম সংরক্ষিত আছে (ইবন ইসহাক, আল-সিরাহ আল-নাবাবিয়্যাহ, ২/৩৫৪-৩৫৬, বৈরুত: দার আল-কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, ২০০৪)।
একইভাবে পরবর্তী বছর সংঘটিত ওহুদ যুদ্ধেও মৃতদের তালিকা রাখা হয়েছিল। এই তালিকাগুলো শুধু ঐতিহাসিক দলিল নয়, বরং শহীদদের বীরত্ব ও ত্যাগের স্মরণ হিসেবেও কাজ করে।
নারীরাও এ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে আহতদের সেবা, মৃতদেহ সংগ্রহ এবং তাঁদের নিজ শহরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে অংশ নিতেন (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৮১২)।
মৃতদেহের সৎকার
ইসলামি আইনে মৃতদেহের সৎকার একটি সম্মিলিত দায়িত্ব (ফরজে কিফায়া), যার অর্থ মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু সদস্য এ দায়িত্ব পালন করলে সবাই এর দায় থেকে মুক্ত হন। যদি কেউই এ দায়িত্ব পালন না করে এবং তা সমাজের জ্ঞান বা সামর্থ্যের বাইরে না হয়, তবে সবাই এর জন্য দায়ী থাকবে।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি মৃতদেহকে পৃথক কবরে সমাহিত করতে হবে। তবে জরুরি পরিস্থিতিতে, যেমন স্থানের অভাব বা অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে একই কবরে একাধিক দেহ সমাহিত করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে দেহগুলোকে পাশাপাশি রাখতে হয় এবং তাদের মধ্যে পর্যাপ্ত স্থান রাখতে হয়। এ নিয়ম আধুনিক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরাও অনুসরণ করেন।
বেশির ভাগ ফকিহর মতে, শহীদদের দেহ গোসল করানো, কাফন পরানো বা তাঁদের জন্য জানাজার নামাজ পড়া অপরিহার্য নয়। এই নিয়ম বদর ও ওহুদের যুদ্ধের নজিরের ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
শহীদদের ক্ষেত্রে বিশেষ নিয়ম প্রযোজ্য। বেশির ভাগ ফকিহর মতে, শহীদদের দেহ গোসল করানো, কাফন পরানো বা তাঁদের জন্য জানাজার নামাজ পড়া অপরিহার্য নয়। এই নিয়ম বদর ও ওহুদের যুদ্ধের নজিরের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। যেমন ওহুদের যুদ্ধে শহীদদের গোসল ছাড়াই সমাহিত করা হয়েছিল। কারণ, মদিনা থেকে পানি আনা সম্ভব ছিল না (আবদ আল-রহমান ইবন গারমান, আহকাম আল-শহীদ ফি আল-ফিকহ আল-ইসলামি, পৃ. ২৪৮-২৫১, আল-তায়িফ: মাকতাবাহ দার আল-বায়ান আল-হাদিসাহ, ২০০১)।
তবে সাঈদ ইবন মুসাইয়্যাব ও হাসান বসরির মতো কোনো কোনো ফকিহ এ নিয়মের বিরোধিতা করেছিলেন।দ্রুত সৎকার
ইসলামে মৃতদেহ দ্রুত সমাহিত করা মুস্তাহাব (পছন্দনীয়), তবে বাধ্যতামূলক নয়। কিছু ক্ষেত্রে, যেমন প্লেগে আক্রান্ত ব্যক্তি, পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তি বা কোমায় থাকা ব্যক্তির ক্ষেত্রে মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এক দিন–রাত অপেক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয় (ফাতহ আল-বারি শরহ সহিহ আল-বুখারি, ৩/১৮৪, বৈরুত: দার আল-মারিফাহ)।
যদি অপরাধের শিকার হয়ে মৃত্যু হয়েছে বলে সন্দেহ থাকে, তবে তদন্তের জন্য সৎকার স্থগিত রাখা যায়। এ ছাড়া মৃতদেহের পচন রোধে বা আত্মীয়দের আগমনের জন্যও দাফন-কাফনে দেরি করা যায় (আবদ আল-রাউফ আল-মিনাওয়ি, ফায়য আল-কাদির শরহ আল-জামি আল-সাগির, ৩/৩১০, কায়রো: আল-মাকতাবাহ আল-তুজারিয়্যাহ আল-কুবরা, ১৯৩৭)।
দেহ উত্তোলন
যদি অপরাধের শিকার হয়ে মৃত্যু হয়েছে বলে সন্দেহ থাকে, তবে তদন্তের জন্য সৎকার স্থগিত রাখা যায়।
ইসলামি আইনে কবর খুঁড়ে দেহ উত্তোলন সাধারণত নিষিদ্ধ, তবে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। ফকিহরা তিনটি ক্ষেত্রে দেহ উত্তোলনের বিষয়ে আলোচনা করেছেন: ধর্মীয় কারণ, নাগরিক দায়বদ্ধতা এবং জনস্বার্থ (আবদ আল্লাহ ইবন উমার ইবন মুহাম্মদ ইবন আল-সাহায়বানি, আহকাম আল-মাকাবির ফি আল-শরিয়াহ, পৃ. ৪৯২, আল-দামাম: দার ইবন আল-জাওজি, ২০০৫)।
যেমন ফরেনসিক তদন্তের জন্য দেহ তোলা হলে সেটাকে জনস্বার্থের কারণ বলে বিবেচনা করা যায়।
পানিতে সমাহিত করা
সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুর বিষয়ে ইসলামে তিনটি পরিস্থিতি বিবেচনা করা হয়।
প্রথমত, যদি জাহাজ তীরে পৌঁছানো সম্ভব হয় এবং দেহের পচন না হয়, তবে তীরে পৌঁছে সাধারণ কবরে সমাহিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, যদি তীরে পৌঁছানো সম্ভব না হয় এবং কাছকাছি কোনো তীরে মুসলিমদের আবাস থাকে, তাহলে দেহটি কাঠের সঙ্গে বেঁধে পানিতে ভাসিয়ে দিতে হবে, যাতে মুসলিমরা তা সম্মানের সঙ্গে সমাহিত করতে পারে। একই কথা বন্যাকবলিত এলাকার ক্ষেত্রেও, কবর দেওয়ার মতো কাছাকাছি শুকনা জায়গা না পাওয়া গেলে ভাসিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
যদি তীরে পৌঁছানো সম্ভব না হয় এবং কাছকাছি কোনো তীরে মুসলিমদের আবাস থাকে, তাহলে দেহটি কাঠের সঙ্গে বেঁধে পানিতে ভাসিয়ে দিতে হবে, যাতে মুসলিমরা তা সম্মানের সঙ্গে সমাহিত করতে পারে।
তৃতীয়ত, যদি কাছাকাছি তীর শত্রু–অধ্যুষিত হয়, তবে দেহটি ভারী বস্তুর সঙ্গে বেঁধে সমুদ্রে নামিয়ে দিতে হবে (আবদ আল্লাহ ইবন উমার ইবন মুহাম্মদ ইবন আল-সাহায়বানি, আহকাম আল-মাকাবির ফি আল-শরিয়াহ, পৃ. ৪৩-৪৫, আল-দামাম: দার ইবন আল-জাওজি, ২০০৫)।
সারকথা
পূর্বেকার ফকিহরা সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে যে নিয়মগুলো প্রণয়ন করেছিলেন, তা আজও মুসলিম সমাজে প্রাসঙ্গিক। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের জন্য এই নিয়মগুলো জানা অত্যন্ত জরুরি, যাতে তাঁরা মুসলিম প্রেক্ষাপটে কাজ করার সময় স্থানীয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করতে পারেন।
ইসলামি আইন ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে মৃতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং জীবিতদের আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা নিশ্চিত করা সম্ভব।
সূত্র: হিউম্যানিটেরিয়ান ল অ্যান্ড পলিসি ব্লগ