মুক্তমঞ্চ ডেস্ক, এইউজেডনিউজ২৪: শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষ করে পিইসি ও জেএসসি নামক পরীক্ষাগুলোর নামে কোমলমতি শিশু ও কিশোর শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই দুটি পরীক্ষার পড়ার চাপ শেষ হতে না হতেই শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে এসএসসি’র সিলেবাস ও শুরু থেকে নিতে হয় আরেকটি বড় পাবলিক পরীক্ষার প্রস্তুতি। এভাবে পড়ার চাপেই এসব শিক্ষার্থীদের শৈশব ও কৈশোর নুইয়ে পড়ছে। শিক্ষাজীবন শুরু হওয়ার পাঁচ থেকে দশ বছরের মাথায় তিন-তিনটি পরীক্ষা ও অতিরিক্ত পাঠের চাপের মধ্যে পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
পরীক্ষাগুলোতে উত্তীর্ণ হওয়া-ভাল রেজাল্ট করা অর্থ্যাৎ A+ পাওয়ার জন্য বেশির ভাগ শিক্ষার্থীদের ওপর তাদের অভিভাবকদের যেমন একটি চাপ থাকে, তেমনি বিদ্যালয় থেকেও প্রচন্ড চাপে রাখা হয় তাদের।
A+ না পেলে ভবিষ্যতে ভাল কিছু করতে পারবে না; সন্তান A+ না পেলে অভিভাবক গর্ব করে রেজাল্টের কথা বলতে পারবে না, এমন মানসিক চাহিদার কারণে অভিভাবক তার সন্তানকে যেমন পড়া-লেখার জন্য প্রচন্ড চাপে রাখেন, তেমনি বিদ্যালয়ের সুনাম রক্ষায় শিক্ষার্থীরা ভাল রেজাল্ট করতে হবে, বেশি বেশি A+ গোল্ডেন A+ এবং বৃত্তি পেতে হবে; এ জন্য শিক্ষকরাও মরিয়া হয়ে উঠেন। এ দুই পক্ষের চাপে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা পড়া-লেখা নামের পাহাড়সম বোঝা বহন করতে হচ্ছে পিইসি পরীক্ষা থেকেই।
যার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বড় ধরেেনর ক্লান্তি ও অবসাদ ভর করছে। এর বিরূপ প্রভাব অনেক শিক্ষার্থীর পরবর্তী শিক্ষাজীবন বা ব্যক্তিজীবনেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া বয়ে আনছে।
পিইসি পরীক্ষার ধাপটি পার করার জন্য বিদ্যালয় ও অভিভাবক প্রথম থেকে শিক্ষার্থীদের প্রচন্ড পড়ার চাপে রাখলেও শেষ পর্যন্ত অধিক ভাল ফলাফলের আশায় উভয় পক্ষই গা ভাসিয়ে দেয় ফাঁস হওয়া প্রশ্নের খোঁজে। সেই প্রশ্ন ফাঁসরোধে প্রশ্নের কাঠামোয় কিছু পরিবর্তনসহ কিছু পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে করে এই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর পড়ার বোঝাটা আরও বাড়ানো হয়েছে।
এ বছর দুদকের সুপারিশক্রমে এসএসসি নির্বাচনী পরীক্ষায় এক বা একাধিক বিষয়ে যারা অনুত্তীর্ণ হবে তাদের মূল পরীক্ষার জন্য ফরম ফিলাপ করতে দেয়া হবে না। মানে তারা এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অযোগ্য বিবেচিত হবে। এ বিষয়ে কিছু কথা ও প্রশ্ন থেকে যায়! এদেশে চাকরি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হওয়ারও নজির রয়েছে। দুদককে দৃশ্যত কখনো কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। অথচ দুদকের সুপারিশে শিক্ষা বিভাগ একটি কঠিন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে এসএসসি ও অন্যান্য পরীক্ষার্থীদের ওপর। বরং উচিত ছিল এক বা দুই বিষয়ে যারা ২৫-৩০ পাবে তাদের বিষয়টি শিথিল রাখা। সেটা অংক অথবা ইংরেজি বিষয় হতে পারে। কারণ নির্বাচনী পরীক্ষার পরও চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে দুই আড়াই মাস সময় পায় শিক্ষার্থীরা। তাদের মূল পরীক্ষার আগ পর্যন্ত এ সময়টা কাজে লাগিয়ে হয়তো একটা ভাল রেজাল্ট করার সুযোগ থাকতো ওইসব শিক্ষার্থীদের।
অথচ শিক্ষার্থীকে একটি বা দুটি পরীক্ষায় পাশ নম্বর উঠাতে না পারায় নির্বাচনী পরীক্ষায় ঠেকিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে একটি বছর কেড়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। এ সিদ্ধান্তের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া কি হবে, সেটা কখনো ভেবে দেখেছেন? সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী স্বাভাবিকভাবেই মানসিক পীড়নে পড়বে। এসব শিক্ষার্থীর কেউ কেউ পড়ালেখার ইতি টানিয়ে বখাটে বা সামাজিক উচ্ছন্নে জড়িয়ে পড়তে পারে। দিন শেষে সংশ্লিষ্ট অভিভাবককেও ওই শিক্ষার্থীর জন্য বহু ত্যাগ ও বিড়ম্বনা সহ্য করতে হবে।
অথচ এই দুটি পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করার জন্য রীতিমত যুদ্ধে নামতে হচ্ছে অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের। এ পরীক্ষাগুলোতে অংশ গ্রহণকারীরা বোর্ড বইয়ের পাশাপাশি দুই-তিন কোম্পানির গাইড বই (বর্তমানে যার নাম পরিববর্তন করে শিক্ষা সহায়িকা রাখা হয়েছে) সংগ্রহ করেও পাঠ গ্রহণ করছে। উদ্দেশ্য ভাল ফলাফল করা।
পিইসি ও জেএসসি’র মানবণ্টন সিলেবাসে এমন কিছু প্রশ্ন চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে যা শিক্ষিত পরিবারের ক্ষেত্রেও এসব সাজেশন নিজ সন্তানকে পাঠদান করাতে পারছে না। যার কারণে সন্তানের পড়া-লেখার জন্য প্রাইভেট, কোচিং ও শিক্ষকদের দারস্ত হতে হচ্ছে। প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা শিক্ষকের নিকট স্মরণাপন্ন হতে হচ্ছে অভিভাবক মহলকে। আর শিক্ষকদেরই বা দোষ কোথায়? অভিভাবক পড়া বোঝেন না, নিজের সন্তানদের পড়াতে পারছেন না, যে কারণে বাধ্য হয়েই পাইভেট শিক্ষকদের স্মরণাপন্ন হতে হচ্ছে।
শিক্ষক সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা, নীতি নির্ধারকরা বোর্ড বই পড়তে বলেন। অথচ জেএসসি ও এসএসসি’র কোনো কোনো বিষয়ে ১৫% থেকে ২৫% প্রশ্ন করা হয় বই থেকে। সৃজনশীলতার নাম করে বাকি প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গাইড বই ও পাইভেটের উপরই নির্ভর করতে হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো- বই কোম্পানির কোটি কোটি টাকার গাইড বই বিক্রয়ের জন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বলির পাঠা বানানো হচ্ছে না তো। এ চক্রে শিক্ষা বিভাগের নীতি নির্ধারকদের কেউ জড়িত কিনা এ পশ্ন উঠাও অস্বাভাবিক নয়।
যেসব নীতি নির্ধারক কিছুদিন পরপর শিক্ষার সিলেবাস, পাঠপদ্ধতি পরিবর্তন করছেন সেই আপনাদের একশজন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২০% শিক্ষার্থীর কথা মাথায় রেখে এগুলো করলে হবে না, বরং ৮০% জন শিক্ষাথীর কথা ভাবতে হবে। অতিরিক্ত পাঠের চাপে শিক্ষার্থীদের এখন ভোর ৬টায় পাইভেট, কোচিংয়ে যেতে হচ্ছে; সেখান থেকেই কোনো কোনো শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যেতে হচ্ছে। ক্লান্ত শরীরে এদের বিকেলে বাসায় ফিরতে হচ্ছে। আবার বাসায় পাইভেট শিক্ষকের নিকট পড়া এবং পরে বিদ্যালয়ের পড়া সামলাতে শিক্ষার্থীদের রাত বারোটা/একটা পর্যন্ত পড়া নিয়ে বসে থাকতে দেখেছি। এটা অমানবিক ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। সময় এবং পড়ালেখার পদ্ধতির মারপেঁচে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এখন রীতিমত জিম্মি ও দিশেহারা। তাই এমন জিম্মিদশা থেকে উত্তোরণ আবশ্যক।
পিইসি এবং জেএসসি বাতিল করে আগের পদ্ধতি ফিরিয়ে দেয়া হোক। প্রশ্ন কাঠামো পরিবর্তন করে ৫০% আগের পদ্ধতি (অর্থ্যাৎ অধ্যায় শেষে অনুশীলনী থেকে প্রশ্ন থাকবে) বাকী ৫০% সৃজনশীল করা হোক।
শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য বন্ধ করতে তাই ৫০% অনুশীলনী থেকে প্রশ্ন রাখা (যা এক সময় ছিল) আর ৫০% সৃজনশীল রাখা যেতে পারে। পাশাপাশি একটি স্বচ্ছ ও ফেয়ার পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা। আর ২৩-২৫টি Letter, Application, CV, Paragraph, Dialogue, Composition পড়লেও অনেক সময় একটি কমন থাকে না এ সকল সিলেবাস, শিক্ষানীতি বন্ধ করা হোক এবং আবারো বলি প্রশ্ন ব্যাংক করা হোক যাতে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখাটা বিপলে না যায়। পড়া অল্প-বেশি যাই-ই হোক সুনির্দিষ্ট পাঠ পরিকল্পনা দেয়া হোক। শিক্ষার্থীরা যেন পড়ে পরীক্ষা দিতে গিয়ে বিভ্রত, বিষন্ন না হতে হয়।
গাজী সালাহউদ্দিন, লেখক: শিক্ষক, সাংবাদিক ও চারুশিল্পী