আরাকানে যুদ্ধ: নেপথ্যে বিশ্বশক্তির দ্বন্দ্ব
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য যাকে আমরা আরাকান নামে জানি, সেই আরকান আজ আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির এক নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। আরাকানে চীনের কাইউকফিউ-ইউনান গ্যাস ও তেলের পাইপলাইন রুট, যা তাদের জ্বালানি নিরাপত্তার এক বিকল্প করিডর। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আনা তেল ও গ্যাস বঙ্গোপসাগর থেকে চীনের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে প্রবাহিত হয়।
এই পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হলে চীনকে মালাক্কা প্রণালির মাধ্যমে অনেক পথ ঘুরে এই সরবরাহ করতে হবে, যা শুধু ব্যয়বহুলই নয়, কিছুটা বিপজ্জনকও বটে। যেকোনো সংঘাতময় পরিস্থিতিতে ভারত ও পশ্চিমা শক্তিগুলো এই সরু সরবরাহ সমুদ্রপথ আটকে দিতে পারে। ভারতের শিলিগুড়ি করিডরের ‘চিকেন নেক’-এর মতো এটিও চীনের জন্য এক ‘চিকেন নেক’।
মিয়ানমারের এ গৃহযুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি ক্রমে ঘোলা হয়ে উঠছে। এখন আরাকান আর্মি (এএ) রাখাইন রাজ্যের বেশির ভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে এবং চীনের পাইপলাইন ও ভারতের কালাদান-মাল্টিমোডাল করিডর এলাকায় এই যুদ্ধ চলছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এবং কোনো রকম সিত্তেসহ কয়েকটি এলাকা দখলে রেখেছে।
এ পরিস্থিতি ঘিরে আন্তর্জাতিক কূটনীতি দ্রুত জটিল হয়ে উঠছে। আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো বর্তমানে সেই অস্থিরতার উৎস হয়ে উঠেছে। যদিও এগুলোর কার্যক্রম মূলত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে; তবু চীনা অর্থনৈতিক করিডরও এখন তাদের হামলার আওতায় এসেছে।
রাখাইন এখন আর শুধুই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকট নয় — এটি হয়ে উঠছে বিশ্বশক্তির ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্র। যুক্তরাষ্ট্র যদি আরাকান আর্মিকে চীনা পাইপলাইন বাধাগ্রস্ত করতে উৎসাহ দেয়, তাহলে এই ছায়াযুদ্ধ শুধু রাখাইনে সীমাবদ্ধ থাকবে না — তার ধাক্কা লাগবে বাংলাদেশের সীমান্ত, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে।
চীনের করিডর বনাম যুক্তরাষ্ট্রের চাপ
চীন যেভাবে কাইউকফিউ বন্দর থেকে তেল-গ্যাস পরিবহন করে সরাসরি ইউনানে নিচ্ছে, তাতে মালাক্কাপ্রণালির ওপর নির্ভরতা বহুলাংশে কমিয়ে আনে, যেখানে মার্কিন নৌবাহিনীর আধিপত্য বিদ্যমান। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এই করিডরে অস্থিরতা তৈরি হোক, যাতে চীনের ‘স্ট্র্যাটেজিক গভীরতা’ হুমকির মুখে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিভাগের দুজন উপমন্ত্রী ও কিছুদিন আগে প্রশান্ত মহাসাগর কমান্ডের উপপ্রধানের বাংলাদেশ সফর এই ইঙ্গিতই দেয়।
তা ছাড়া বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের একটি মার্কিন কোম্পানিতে উপদেষ্টা হিসেবে আগমনও অনেকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছেন। এর সঙ্গে কিছুদিন আগে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধানকে তাঁর সহযোগীসহ আটক করাও এ বিষয়ের সঙ্গে জড়িত বলে অনেকে মনে করছেন। তিনি অনেক দিন থেকে বাংলাদেশে থেকে তাঁর কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সরকার জানত; কিন্তু এত দিন তাঁকে আটক করা হয়নি। এ কারণে এখন তাঁর আটককে এ বিষয়ের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
আরসাকে অনেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দালাল বলে মনে করেন। তাঁরা রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আক্রমণে সহায়তা করেছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়। তবে আরও একটি সশস্ত্র দল যা আরএসও নামে পরিচিত, বর্তমানে আরাকানে সশস্ত্র অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এগোবে তা এখনো পরিষ্কার হয়নি। তবে তাঁরা যে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করবে, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশে ১০ লাখ রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাস করছে। তাঁরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার, ফলে তাদের মধ্যে প্রতিশোধ নেওয়ার মানসিকতা রয়েছে। তারা আরাকানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত। তবে আরাকান আর্মিকে সঙ্গে নিয়েই তাদের কাজটি করতে হবে। বাংলাদেশকে এ বিষয়ে কঠিন দোটানায় পড়তে হবে। বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে চীনের স্বার্থ বিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়া বাংলাদেশের জন্য ঠিক হবে না; আবার যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়ে যাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর হবে না।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সাম্প্রতিক চীন সফর বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক হিসেবে ধরা হচ্ছে। চীন বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে শুধু স্বীকৃতিই দেয়নি, এর সঙ্গে বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও তিস্তা নদী প্রকল্পে তথা সারা দেশের নদ-নদীর ব্যবস্থাপনায় ৫০ বছরের সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশ যে চীনের ক্ষতিকর কোনো কাজে অন্যদের সহায়তা করবে, তা আশা করা যায় না। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করবে, তা দেখার বিষয়। এই দুই পরাশক্তির দোটানায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কী হবে তা ভাবার বিষয়।
ভারতের কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্প
ভারত যে কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্পের মাধ্যমে কলকাতা থেকে মিজোরাম পর্যন্ত একটি বিকল্প রুট তৈরি করছে, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ পড়ে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রিত পালেটওয়া অঞ্চলের ওপর। ফলে এই সংঘাতে ভারতের কৌশলগত প্রকল্পটি প্রকৃতপক্ষে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। এ প্রকল্প রক্ষায় ভারত বরাবরই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু এখন যদি যুক্তরাষ্ট্র আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গাদের উৎসাহ দেয় এবং ভারত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পক্ষ নেয়, তাহলে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে মিয়ানমার ইস্যুতে মতবিরোধ সৃষ্টি হতে পারে।
ভারত চাইবে তাঁদের বিনিয়োগ যাতে সুরক্ষিত থাকে এবং কালাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্প যাতে কোনোভাবেই ঝুঁকিতে না পড়ে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে কোনো রকমের ট্রানজিট কার্যকর হবে না। সে কারণে কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্টের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে এ বিষয়ে ভারতের কৌশলগত নীতি এখনো স্পষ্ট নয়।
বাংলাদেশ: আগুনের চারপাশে অথচ নিরপেক্ষ
রাখাইন ও চট্টগ্রাম সীমান্তে আরাকান আর্মির পুনরুত্থান বাংলাদেশের জন্য একাধিক সমস্যা তৈরি করছে—
১. সীমান্তের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে;
২. রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট আরও বাড়তে পারে;
৩. বর্ডার এলাকায় জঙ্গি সংগঠন বা অস্ত্র পাচারের হুমকি তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত নিরপেক্ষ থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিযোগিতা এবং ভারত-মিয়ানমার সামরিক সমীকরণে ঢাকা বিশাল চাপের মুখে পড়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ চাইছে চট্টগ্রাম বন্দরকে আঞ্চলিক ট্রানজিট কেন্দ্রে রূপান্তর করতে; কিন্তু আরাকানের অস্থিরতা এবং মার্কিন-চীন সংঘর্ষ যদি বন্দরের পাশেই রণাঙ্গনের রূপ নেয়, তবে বাংলাদেশের স্বপ্ন ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য তিনটি প্রধান করণীয়—
১. সীমান্ত গোয়েন্দা ও সামরিক প্রস্তুতি বাড়ানো বিশেষ করে বান্দরবান ও টেকনাফ এলাকায়;
২. আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ফোরামে সক্রিয় হওয়া জাতিসংঘ ও আসিয়ান প্ল্যাটফর্মে রাখাইন সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানে জোর দেওয়া
৩। যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ভারত তিন পক্ষের সঙ্গেই ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা। যেন বাংলাদেশ কোনো পক্ষের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে পরে।
শেষ কথা
রাখাইন এখন আর শুধুই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকট নয় — এটি হয়ে উঠছে বিশ্বশক্তির ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্র। যুক্তরাষ্ট্র যদি আরাকান আর্মিকে চীনা পাইপলাইন বাধাগ্রস্ত করতে উৎসাহ দেয়, তাহলে এই ছায়াযুদ্ধ শুধু রাখাইনে সীমাবদ্ধ থাকবে না — তার ধাক্কা লাগবে বাংলাদেশের সীমান্ত, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে। এ সময়ে বাংলাদেশ যেন শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক কৌশল ও নিরপেক্ষ অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করে। কারণ, সামনের দিনগুলোতে আরাকান আমাদের কেবল প্রতিবেশী নয়,একটি স্ট্র্যাটেজিক ঝুঁকিও বটে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল(অব.) তুষার কান্তি চাকমা: অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা
(মতামত লেখকের নিজস্ব)