সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩৩ গুণ। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, এই অভাবনীয় বৃদ্ধি মূলত অবৈধ উপার্জন ও অর্থপাচারেরই ইঙ্গিত দেয়।
প্রতিবছরের মতো এবারও সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গচ্ছিত অর্থের তথ্য প্রকাশ করেছে। ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত হিসাববর্ষ অনুযায়ী, বাংলাদেশি নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের নামে সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ সুইস ফ্রাঁ। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী (প্রতি ফ্রাঁ ১৪৯.৬৯ টাকা ধরে), এর টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮,৮৩৪ কোটি টাকা।
এটি ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ৩৩ গুণ বেশি। ২০২৩ সালে বাংলাদেশিদের নামে সুইস ব্যাংকে জমা ছিল মাত্র ১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্রাঁ, যার টাকার অঙ্কে পরিমাণ ২৬৪ কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশি আমানতের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৮ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ২০২৪ সালটি ছিল বাংলাদেশের জন্য রাজনৈতিকভাবে একটি উত্তাল ও সংকটময় বছর। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ, ছাত্র-জনতা এবং বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে নির্বাচন ঘিরে অনিয়ম, দমন-পীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, এই আন্দোলনের জেরে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা ও শাসনব্যবস্থার সম্ভাব্য পরিবর্তনের আশঙ্কা বাড়তে থাকে। এর সুযোগে দেশের ধনী শ্রেণি, ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদ এবং প্রভাবশালী ব্যবসায়ী মহল নিরাপদে অর্থ সরিয়ে নেওয়ার জন্য সুইস ব্যাংকের মতো গোপনীয়তা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বিশদ পরিসংখ্যান ও তথ্য সুইস গভর্নমেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ও সমঝোতার (MoU) মাধ্যমে সংগ্রহ করা সম্ভব। এতে বোঝা যাবে কোন অর্থ বৈধ এবং কোনটা অবৈধ উৎস থেকে এসেছে। যদি দেখা যায়, বড় অংশটি অবৈধ উপার্জন, তখন সরকারকে কঠোর আইনি ও কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এই ধরনের অর্থ পাচারের পেছনে শুধু দুর্নীতি, ব্যাংক লুটপাট, ক্ষমতার অপব্যবহার-ই দায়ী নয়, বরং ভুয়া আমদানি-রপ্তানি বিল, মূল্য ফাঁকির মতো কৌশল ব্যবহার করেও বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়ে থাকে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের প্রকৃত উৎস চিহ্নিত করা এবং তা ফিরিয়ে আনার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে কোনো স্বতন্ত্র ট্যাক্স তথ্য বিনিময় চুক্তি না থাকলেও, দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায় এ ধরনের তথ্য আদান-প্রদান সম্ভব।