ছোট্ট এক রাষ্ট্র ইসরায়েল। তারও ছোট্ট রাজধানী তেল আবিব, যেটি ভূমধ্যসাগরের পাড়ে অবস্থিত এ দেশের প্রাণকেন্দ্র। প্রযুক্তি, ব্যবসা এবং কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দু এই শহরটি এখন যুদ্ধের ছায়ায় কাঁপছে। একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় শহরের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আকাশে যুদ্ধবিমান, ভূমিতে প্রতিরক্ষা ব্যস্ততা, আর জনগণের মধ্যে অজানা ভয়—এই হচ্ছে বর্তমানে তেল আবিবের চিত্র।
ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা ইরানের আকাশসীমায় প্রবেশ করে সফলভাবে বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও গোয়েন্দা সক্ষমতার পরিচায়ক। কিন্তু ইরানের আকাশে বিজয়ী হয়ে ফিরে আসার পরও নিজ দেশে তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, নিরাপত্তার স্বার্থে ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর একটি অংশ পার্শ্ববর্তী দেশ সাইপ্রাসে স্থানান্তরিত হয়েছে।
ইরান: মিসাইল ও ড্রোনের পরাশক্তি!
ইরানের নিজস্ব বিমান বা নৌবাহিনী যতটা না শক্তিশালী, তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর তাদের মিসাইল ও ড্রোন শক্তি। ২৫-৩০ বছর আগে শুরু হওয়া এই কর্মসূচি এখন পৌঁছেছে এক বিস্ময়কর উচ্চতায়। হাজার হাজার ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল রয়েছে তাদের ভাণ্ডারে। বিভিন্ন রেঞ্জ, গতিবিধি ও ধ্বংসক্ষমতাসম্পন্ন এসব অস্ত্র অত্যন্ত দ্রুত মোতায়েন করা সম্ভব। এমনকি তারা দাবি করেছে, তারা এখন হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে সক্ষম—যা শব্দের চেয়ে বহু গুণ দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব। বিশ্বে এখন পর্যন্ত রাশিয়া ও চীন এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র কার্যকরভাবে মোতায়েন করেছে।
কৌশলের যুদ্ধে কে এগিয়ে?
ইসরায়েলের বিমান ও ড্রোন প্রযুক্তি, বিশেষ করে F-35 যুদ্ধবিমান, Iron Dome, David’s Sling ইত্যাদি আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। কিন্তু ইরান যেভাবে তাদের ভ্রাম্যমাণ লঞ্চার ব্যবহার করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, তা এসব ডিফেন্স সিস্টেমকে বারবার চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে। ইরানের মিসাইল হামলায় ইসরায়েল চরমভাবে বিপর্যস্ত। যা ইসরায়েল কল্পনাও করেনি, তা-ই ঘটছে।
অত্যাধুনিক ভূমিতে ইরানের কৌশল তুলনামূলকভাবে সহজ কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর। তারা এক জায়গায় বেশিক্ষণ লঞ্চার রাখে না—এক জায়গা থেকে মিসাইল ছুড়ে, তারপর দ্রুত সরে যায় অন্যত্র। ফলে এগুলোর অবস্থান শনাক্ত করা এবং ধ্বংস করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।
ফলে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রচণ্ড চাপ পড়েছে। পশ্চিমা সহযোগিতায় তৈরি প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির মজুদের ওপর রসদের সংকটও দেখা দিয়েছে। ইসরায়েল এখন দ্বন্দ্বে—কৌশলগত আগ্রাসনের মাধ্যমে আকাশে প্রভাব ধরে রাখতে পারলেও মাটিতে তারা নিরাপদ নয়।
ইরানের সংযম: যেন যুদ্ধ নয়, যুদ্ধ প্রস্তুতি!
ইরানের সশস্ত্র বাহিনী সম্প্রতি ইসরায়েলের লক্ষ্যবস্তুতে একাধিক পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চাললালেও এখনো তারা নতুন প্রজন্মের বা অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছেন না। ইরান এখনো ব্যবহার করেনি শহীদ হাজ কাসেম ক্ষেপণাস্ত্র, যার নামকরণ করা হয়েছে কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সোলাইমানির নামে। এটি একটি সলিড-ফুয়েল ক্ষেপণাস্ত্র এবং ইরানের পক্ষ থেকে একে হাইপারসনিক বলা হয়। কারণ এর গতিবেগ শব্দের গতির পাঁচগুণ। তবে পশ্চিমা বিশ্লেষকরা এই ‘হাইপারসনিক’ ট্যাগ মানতে নারাজ। তাদের যুক্তি, এর ত্রিমাত্রিক চলাচলের সক্ষমতা নেই।
তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো—ইরান এখনো ব্যবহার করেনি ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের ভাষায় ‘ডুমসডে অস্ত্র’ হিসেবে পরিচিত খোররামশাহর ক্ষেপণাস্ত্র। এটি ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। এর ওয়ারহেড বহনক্ষমতা ১ হাজার ৮০০ কেজি পর্যন্ত। ২০১৭ সালে এটি উন্মোচন করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সামরিক অভিযানে ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।
১৯ জুন পর্যন্ত ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস থ্রি’-এর অংশ হিসেবে ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ডস কর্পস (আইআরজিসি) ইসরায়েলের ওপর ১৩ দফা পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। সামরিক বিশ্লেষকেরা ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন, যা ইসরায়েলি আকাশ প্রতিরক্ষা কৌশলকে প্রায় অকেজো করে তুলেছে। এগুলোর মধ্যে আছে—ইরান দিনে ও রাতে, উভয় সময়েই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে। এতে সময় ঠিক করতে ইসরায়েল তার প্রতিরক্ষার সংগঠিত কৌশল গঠনে ব্যর্থ হচ্ছে। ইরান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও আত্মঘাতী ড্রোনসহ বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করেছে। ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিভিন্ন ধরণের ও অনিয়মিত রণকৌশল প্রয়োগ করেছে, এতে আগাম পূর্বাভাস দিতে পারছে না ইসরায়েল। ইরান ইসরায়েলের বিভিন্ন জায়গায় একযোগে হামলা চালিয়ে তাদের চমকে দিচ্ছে। ইরানের কাছে বিশাল ডেটাবেস আছে। এতে ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটি, তেল শোধনাগার, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোসহ নানা লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো সম্ভব হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রকে সামনে রেখে প্রস্তুতি
ইরান জানে, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িয়ে পড়তে পারে। আর সেই যুদ্ধ হবে আরও ভয়াবহ। তাই ইরান চায় না এখনই তাদের হাইপারসনিক বা স্ট্র্যাটেজিক মিসাইল ব্যবহার করে শক্তির সবটুকু প্রকাশ করতে। পাশাপাশি বিশ্বের অঘোষিত পারমাণবিক শক্তিগুলোর একটি ইসরায়েল। ইরান যদি অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে ইসরায়েলের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তোলে, তবে শেষ পর্যন্ত তারা পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারে যেতে পারে। এর ফলে যুদ্ধ শুধু মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, ছড়িয়ে পড়বে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
ভৌগোলিক বাস্তবতা ও যুদ্ধের বিস্তার
ইরান এবং ইসরায়েল—দুই দেশের মধ্যে রয়েছে প্রায় ১,৫০০ কিলোমিটারের দূরত্ব। তবু এই দূরত্ব মিসাইল ও ড্রোন প্রযুক্তির কাছে কোনো বাধা নয়। ইরান এই দীর্ঘ দূরত্ব পেরিয়ে নিয়মিতভাবে আঘাত হানছে। আর ইসরায়েল পাল্টা দিচ্ছে অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা তৎপরতা ও বিমান আক্রমণের মাধ্যমে। সাম্প্রতিক সময়ে লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠীসহ অন্যান্য ইরানঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলোকেও ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে জড়ানোর আলামত দেখা যাচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে এখন শুধু যুদ্ধবিমান নয়, উড়ছে অনিশ্চয়তা আর আতঙ্ক। ইসরায়েল তাদের প্রযুক্তিগত আধিপত্য দেখালেও, ইরান তাদের অপ্রত্যাশিত কৌশলে বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করছে। একদিকে সরাসরি হামলা, অন্যদিকে প্রতিরক্ষার দুর্বলতা—এই দ্বৈত চাপে ইসরায়েল যেমন বিপর্যস্ত, তেমনি ইরানও চরম হিসেব-নিকেশ করে এগোচ্ছে।
ইসরায়েল: প্রযুক্তিতে শক্তিশালী, কিন্তু ভেতরে হিমশীতল!
ইসরায়েলের হাতে রয়েছে সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান, ড্রোন, স্যাটেলাইট ইন্টেলিজেন্স এবং ডোম প্রতিরক্ষা। কিন্তু প্রতিনিয়ত আঘাত আর আতঙ্ক তাদের সমাজে একধরনের মানসিক যুদ্ধ তৈরি করছে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও এই যুদ্ধ রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আবার কিছু শ্রেণি চাইছে ‘পুরোদমে পাল্টা জবাব’।
ইরানি হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ২৪ জন নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলের ৫ হাজার ১১০ জনকে বাস্তুচ্যুত ঘোষণা করা হয়েছে। অপরদিকে ইসরায়েলের হামলায় ইরানে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৬৩৯ জন নিহত হয়েছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে এখন শুধু বিমান নয়, ছুটছে বারুদ আর বার্তা—শক্তি প্রদর্শন আর সীমিত সংযমের মিশেলে।ইসরায়েল হয়তো প্রযুক্তিতে এগিয়ে, কিন্তু ইরান যুদ্ধক্ষেত্রে চমকে দিচ্ছে তাদের চেনা প্রতিপক্ষকে। এই সংঘর্ষ শেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে একথা নিশ্চিত, মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্রে একটি বড় পরিবর্তনের আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠছে।