১৩ জুন ইরানকে লক্ষ্য করে ইসরায়েলের নতুন যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সূচনা—যার থেকে কেউই লাভবান হবে না, এমনকি ইসরায়েল সরকারও নয়। বরং বহু মানুষ ভোগান্তির শিকার হবে। ইতিমধ্যে গোলাগুলির লড়াইয়ে ইরানে অন্তত ৮০ জন এবং ইসরায়েলে ১০ জন নিহত হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এই যুদ্ধকে ‘প্রি-এম্পটিভ’ বা প্রতিরোধমূলক বলে অভিহিত করেছেন, যার লক্ষ্য হচ্ছে তেহরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথ থেকে বিরত রাখা। এইভাবে তিনি এক ভয়ংকর কৌশলগত ভুল করেছেন, যেমনটা করেছিলেন ইরাক আক্রমণের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার।
ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র যখন মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে ছুটে গিয়ে ইরানি সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানতে থাকে, তখনই বিশ্ব আরও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের নেতৃত্বে ইরাক আক্রমণের মতোই, এই উসকানিমূলক হামলাও একটি অস্থির অঞ্চলকে আরও বিপজ্জনক করে তুলবে।
নেতানিয়াহুর দাবি অনুযায়ী, এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ধ্বংস করা। এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনী নাতানজ, ইসফাহান ও ফোর্দো—এই তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে এবং বিভিন্ন মাত্রার ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছে। তবে এতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটা মোটেও বাস্তবসম্মত নয়—এবং নেতানিয়াহু তা ভালো করেই জানেন।
নাতানজ স্থাপনাটি ইরানি কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবেই গভীর মাটির নিচে নির্মাণ করেছে যাতে এটিকে ধ্বংস করতে হলে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ‘বান্কার-বাস্টার’ বোমার প্রয়োজন হয়। এমন বোমা ইসরায়েলের নেই। যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর’ বা ‘ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স এয়ার ব্লাস্ট’ বোমা ছাড়া এই জায়গাটি ধ্বংস করা সম্ভব নয়। আর ওয়াশিংটন কখনও এই বোমাগুলো ইসরায়েলকে সরবরাহ করেনি ।
নেতানিয়াহুর দ্বিতীয় ঘোষিত লক্ষ্য—ইরানি শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানো—তাও বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। কিছু উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন, এবং ইসরায়েল প্রকাশ্যেই ইরানিদের নিজেদের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এই একতরফা আগ্রাসন ইরানি জনগণের ক্ষোভ ইসরায়েলের বিরুদ্ধেই বাড়াবে, তাদের সরকারের বিরুদ্ধে নয়—সেটা যতই অবাধ ও গণতান্ত্রিক না হোক।
বরং ইরানি সরকার যে দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, একটি পরমাণু অস্ত্র ইসরায়েলি আগ্রাসন ঠেকাতে প্রয়োজন—সেই দাবিই এখন অনেক ইরানির কাছে আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য যেসব দেশে ইরানের প্রভাব কিছুটা কমেছিল, সেখানেও নেতানিয়াহুর হামলা ইরানের পক্ষে সমর্থন ফিরিয়ে আনতে পারে।
ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন পতনের পর কী ঘটেছিল—সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এই শিক্ষা নেওয়া উচিত ছিল। রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পর সেখানে উগ্রপন্থা ব্যাপক হারে বেড়ে যায় এবং ২০১০ দশকে আইএস (ISIS) নামে এক ভয়ংকর সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে।
ইরানে এমন কোনো সরকার গঠন করা সম্ভব নয়, যা ইসরায়েলের পছন্দসই এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতায় আসে। কারণ, এই দুই দেশের মধ্যে সীমানা নেই—সরাসরি দখল করা সম্ভব নয়।
সব মিলিয়ে, নেতানিয়াহুর এই সামরিক অভিযান হয়তো স্বল্পমেয়াদে কিছু লাভ এনে দেবে—ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বিলম্বিত করা, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা বানচাল করা ইত্যাদি। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এই পদক্ষেপ অঞ্চল ও বিশ্বব্যাপী এক কৌশলগত বিপর্যয় ডেকে আনবে।