‘মুসলিম বিশ্ব’— এই শব্দটি শুনলেই মনে হয়, একটি বড় পরিবার। যেখানে বিশ্বের সব মুসলিম দেশ একে অন্যের পাশে থাকে। মুসলিমদের দুঃখ-দুর্দশায় সবাই একসাথে দাঁড়ায়। কিন্তু বাস্তবতা অনেক ভিন্ন। যেসব ঘটনা আজ ঘটছে, বিশেষ করে গাজা, তেহরান, কাশ্মীর, কিংবা রোহিঙ্গাদের নিয়ে, তা দেখলে প্রশ্ন জাগে— ‘মুসলিম বিশ্ব’ বলে আসলেই কিছু আছে কি? নাকি এই শব্দ কেবলই আমাদের আবেগে তৈরি এক কল্পনার মরীচিকা?
ইসলামের শুরুতে মুসলিম উম্মাহর একটি বাস্তব রূপ ছিল। নবী মুহাম্মদ (সা.) যখন মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, তখন সব মুসলমান ছিল একটি নেতৃত্বের অধীনে। তাঁর মৃত্যুর পর খিলাফতের যুগেও মুসলমানরা একসাথে চলত। তখন মুসলিমদের মধ্যে রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক সংহতি ছিল।
কিন্তু সেই সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। এখন প্রতিটি মুসলিম দেশ স্বাধীন, আলাদা নেতৃত্বে চলে। তাদের নিজস্ব রাজনীতি, নিজস্ব অর্থনীতি এবং আলাদা বিদেশনীতি আছে। ফলে এক সময়ে যে মুসলিম উম্মাহর ধারণা ছিল, এখন তা কেবল ইতিহাসের অংশ।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৫০টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ রয়েছে। কিন্তু এদের মধ্যে খুব কম দেশ একে অপরকে সহায়তা করে। তারা আন্তর্জাতিক মঞ্চে একসাথে কথা বলে না, একসাথে সিদ্ধান্ত নেয় না।
যখন ফিলিস্তিনে শিশুরা মরছে, ঘরবাড়ি ধ্বংস হচ্ছে, তখন কিছু দেশ বিবৃতি দেয়, কেউ নিন্দা জানায়, কেউ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বড় কোনো রাজনৈতিক বা সামরিক উদ্যোগ কেউ নেয় না। অন্যদিকে, ইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকে পশ্চিমা শক্তিগুলো— যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের বেশ কিছু দেশ। তারা প্রকাশ্যেই সমর্থন দেয়।
ফিরে দেখা যাক ২০২৩–২৪ সালের গাজা যুদ্ধ। হাজার হাজার মানুষ মারা গেল, শিশুরা নিহত হলো, বাড়িঘর ধ্বংস হলো। মুসলিম দেশগুলো কী করল? কিছু অর্থ সহায়তা পাঠাল, কেউ কেউ মানবিক ত্রাণ পাঠাল, কেউ নিন্দা করল— এই পর্যন্তই। কিন্তু বড় কোনো পদক্ষেপ? না, তা দেখা যায়নি।
মুসলিম দেশগুলোর একটি সংগঠন আছে— OIC (Organization of Islamic Cooperation)। এটি ৫৭টি মুসলিম দেশের সমন্বয়ে গঠিত। তাদের উদ্দেশ্য হলো মুসলিম বিশ্বে ঐক্য গড়ে তোলা, সমস্যা সমাধানে একসাথে কাজ করা।
কিন্তু এখন পর্যন্ত ওআইসি খুবই দুর্বল ভূমিকা রেখেছে। তারা শুধু বৈঠক করে, বিবৃতি দেয়, প্রস্তাব পাশ করে। কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। গাজা, কাশ্মীর, রোহিঙ্গা, ইয়েমেন, সিরিয়া— সব ক্ষেত্রেই ওআইসির ভূমিকা ছিল নীরব, নিষ্ক্রিয়।
এর পেছনে অনেক কারণ আছে। প্রথমত, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক বিভাজন। যেমন সৌদি আরব ও ইরান দুইটি বড় মুসলিম দেশ, কিন্তু তারা একে অপরের শত্রু। তাদের মধ্যে রয়েছে মতাদর্শগত ও সাম্প্রদায়িক বিরোধ। এই বিরোধ বহু মুসলিম দেশকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে।
দ্বিতীয়ত, কিছু মুসলিম দেশ পশ্চিমা শক্তির ওপর নির্ভরশীল। তারা নিজের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত। তাই ফিলিস্তিনের পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিতে ভয় পায়, কারণ তাতে পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তৃতীয়ত, আরেকটি বড় সমস্যা হলো— ভবিষ্যতের নেতৃত্ব সংকট। মুসলিম বিশ্বের মধ্যে এমন কোনো নেতা নেই, যিনি সবাইকে এক ছাতার নিচে আনতে পারেন। সবাই নিজের অবস্থান ধরে রাখতে চায়, নেতৃত্ব ছাড়তে চায় না। ফলে সবাই আলাদা থাকে।
চতুর্থত, জাতীয় স্বার্থ ও বিদেশনীতি। প্রতিটি মুসলিম দেশ এখন জাতীয়তাবাদকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা ধর্মীয় ঐক্যের চেয়ে নিজের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে বড় করে দেখছে। ফলে ‘উম্মাহ’ এখন আর তাদের অগ্রাধিকার নয়।
সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে এখনও উম্মাহর ধারণা রয়েছে। তারা বিশ্বাস করে, মুসলমানদের এক হওয়ার দরকার। যখন তারা গাজা, কাশ্মীর, বা রোহিঙ্গাদের কষ্ট দেখে, তখন তারা প্রতিবাদ করে, দোয়া করে, সাহায্য পাঠায়।
কিন্তু তাদের সরকার বা নেতৃত্ব এই আবেগকে কাজে লাগায় না। বরং অনেক সময় তারা নিজেদের স্বার্থে এই আবেগকে ব্যবহার করে, কিন্তু বাস্তবে কোনো কাজ করে না।
এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। একদিকে, মুসলমানদের একটি অভিন্ন বিশ্বাস আছে। তারা একই ধর্মে বিশ্বাস করে, একই কাবার দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে, একই কোরআন অনুসরণ করে।
এই অভিন্নতা অনেক শক্তি দিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা কাজে লাগছে না। কারণ নেতৃত্বে বিভাজন, স্বার্থে দ্বন্দ্ব এবং সাহসের অভাব।
তবে এটি একেবারেই মরীচিকা নয়। এটা এখনো সম্ভব, যদি নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়, যদি মুসলিম দেশগুলো সত্যিই ঐক্যবদ্ধ হতে চায়। যদি মুসলমানরা নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য কাজ করতে চায়, তাহলে ‘মুসলিম বিশ্ব’ একদিন বাস্তবও হতে পারে।
‘মুসলিম বিশ্ব’— এই শব্দটি এখনও কোটি মুসলমানের হৃদয়ে আশা জাগায়। কিন্তু সেই আশাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক ঐক্য, সাহসী নেতৃত্ব এবং পারস্পরিক সহযোগিতা। শুধু আবেগ দিয়ে চলবে না। দরকার পরিকল্পনা, কাজ ও ত্যাগ।
আজকের বিশ্বে মুসলিমরা বড় বড় সমস্যার মুখোমুখি। গাজা, কাশ্মীর, রোহিঙ্গা, সিরিয়া, ইরাক, ইরান— সব জায়গায় মুসলিমরা নির্যাতিত। এখন যদি তারা না জাগে, না জোট বাঁধে, তাহলে ‘মুসলিম বিশ্ব’ শব্দটি কেবলই ইতিহাসের এক মরীচিকা হয়ে থাকবে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো তখন বলবে— একটা সময় ছিল, যখন ‘মুসলিম বিশ্ব’ বলে কিছু ছিল বলে মানুষ ভাবত। কিন্তু সেটা ছিল কেবলই কল্পনা, বাস্তবতা নয়