বাবা, সন্তানের মাথার ওপর যার স্নেহচ্ছায়া বটবৃক্ষের মতো, সন্তানের ভালোর জন্য জীবনের প্রায় সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করতে হয় তাকে। বাবা হলো একটি সন্তানের বটবৃক্ষ। বাবাকে দেখেই সন্তান তার সবকিছু গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। কারণ বাবাকে অনুসরণ করে সামনের দিনগুলোতে চলার প্রয়াস।
সন্তানের আদর-শাসন ও বিশ্বস্ততার জায়গা হলো বাবা। আর বাবার তুলনা বাবা নিজেই। বাবা শাশ্বত, চির আপন, চিরন্তন। আজকের দিনটিতে কেমন যেন এক ব্যতিক্রম অনুভূতি দেখতে পেলাম। ৯ বছরের আহরার কারীব ভোর ৬টায় ঘুম ভেঙে তার বাবাকে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বলে, ‘বাবা চলো ছাদে যাই’। কারীবের এই অনুভূতি দেখে বাবা বুঝতে পেরেছে, ‘ছেলে আমার বড় হচ্ছে’। ছাদে উঠে কারীব খোলা আকাশে তাকিয়ে বাবাকে বলে, ‘তুমিই আমার পৃথিবী’। তাই বুঝিয়ে দিলো আজকের দিনটিকে। সুযোগ এসেছে সেই বাবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা-ভালোবাসা প্রকাশের। আজ বিশ্ব বাবা দিবস। বাবাকে হারিয়েছি আজ থেকে ৪২ বছর আগে। বাবা রেখে গেছেন তার আট ছেলেদেরকে। এখন বুঝি আমার বাবা আমাদের জন্য কত কষ্ট করতেন, কেন এত চিন্তা করতেন।
কতোই না কষ্ট করেছেন আমার বাবা, যদিও পৃথিবীর সব বাবারাই সন্তানদের জন্য কষ্ট করে থাকেন। মাও বেঁচে নেই এই পৃথিবীতে। মায়ের মুখে বাবার অনেক স্মৃতি শুনেছি। চাঁদপুর ফরিদগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল কাছিয়াড়া গ্রাম। এই গ্রামটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আমার বাবা মরহুম মাস্টার কলিম উল্লাহ মিয়াজী। পিতা প্রয়াত সোনা মিয়ার (দাদা) ৪ ছেলেমেয়ের মধ্যে মাস্টার কলিম উল্লাহ ছিলেন দ্বিতীয়। ছোট বেলা থেকেই বাবা ছিলেন খুব মেধাবী।
কিন্তু পরিবারের অভাব-অনটন দেখে প্রাথমিক শিক্ষা অবস্থাতেই চলে গেলেন কুমিল্লার কোর্টবাড়ির দক্ষিণ বিজয়পুর ইউনিয়নের মৌলভী বাড়িটিতে। সেখানেই বাড়িতে বাড়িতে গৃহশিক্ষক থেকে তার পড়াশুনার খরচ চালিয়ে যেতেন, আবার তাঁর গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা ও ভাইবোনদের জন্য কিছু জমানো অর্থও পাঠাতেন। বাবা সেখানে নবাব হুচ্চা মিয়া হাইস্কুলে শিক্ষকতা শেষে তদানীন্তন ইস্ট পাকিস্তান মডেল সার্ভে ট্রেইনিং ইন্সটিটিউট-এর ডাইরেক্টর (পরিচালক) হিসেবে যোগদান করেন।
বাংলাদেশ একাডেমী অব রুরাল ডেভেলপমেন্ট-বার্ড-সূচনা লগ্নে এর প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত আখতার হামিদ সাহেবের সহযোগী হিসেবেও কাজে দেশের সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। বাবার এই কথাগুলোর বলার পেছনে একটি কারণ, সেটি হলো একজন আদর্শবান বাবাকে আমি নবাগত সন্তানের বাবা হিসেবে আজকের দিনটিতে স্মরণ করলাম নতুন আঙ্গিকে।
সেই মাস্টার কলিম উল্লাহ ৮ সন্তানের মধ্যে আমি সপ্তম ছেলে হিসেবে আজ বুঝতে পারি বাবা শব্দটি কতোই না মধুর। স্মৃতির আয়নায় আজও ভেসে আসে বাবা গুণকীর্তনের কথা। সন্তান হিসেবে তখন আমি যা বুঝিনি কিংবা বুঝতে চেষ্টা করিনি, এখন বাবা হিসেবে তা উপলব্ধি করছি। যখন সন্তানের শরীর খারাপের খবর শুনি, তখন নিজের ভেতরে একটা তীব্র কষ্ট অনুভূত হয়, হয়তো বা আমার বাবাও এর চেয়ে বেশী কষ্ট পেতেন বাবার ৮ সন্তানের কিছু হলে।
নিজের অজান্তে চোখ ভিজে যায় আর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে, ‘বাবা, তোমার ছেলে তোমার জন্য কিছুই করতে পারছে না, তুমি আমাকে ক্ষমা করো। তুমি তো চলে গেলে না ফেরার দেশে। বাবা, তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি।’ আজও তোমার ছাত্র কিংবা সমবয়সীদের কাছে শুনতে পাই মাস্টার কলিম উল্লাহ আদর্শের কথা। সমাজ উন্নয়ন ও শিক্ষা ব্যবস্থায় সফলতার কথা। বাবা, সন্তানের মাথার ওপর যার স্নেহচ্ছায়া বটবৃক্ষের মতো, সন্তানের ভালোর জন্য জীবনের প্রায় সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করতে হয় তাকে, আদর-শাসন আর বিশ্বস্ততার জায়গা হলো বাবা।
আর বাবার তুলনা বাবা নিজেই। আর বাবা হারানোর কষ্টকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য যখনই ‘মা’ জননী ৮ সহোদরকে মাত্র ১টি যুগ বুকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পেরেছেন। ১৯৯৪ সালের ২৫ মে মাও না ফেরার দেশে চলে গিয়ে পরকালের আসল ঠিকানায় ফাঁড়ি দেন, ঠিক তখনই আবার বাবা’র ভূমিকা পালন করেন আমাদেরই মিঞা ভাই (জন্মদাতা বাবার চেয়েও কোন অংশ কম নয়)। ঠিক এইভাবে চলতে থাকলো বড় ভাইকে ‘বাবা’ নামক শব্দটিতে জায়গা করে নিয়ে।
এরপর প্রয়াত মা-বাবার পর মিঞা ভাইয়ের ছায়াতল থেকে বের হই ২০০৯ সালের ১২ই জুন। বাবাকে হারিয়েছি ৩৬ বছর আগে। ১৯৮৩ সালের ১৭ জুলাই থেকে বাবা, আব্বা, পিতা এই মধুর শব্দগুলো মুছে গেছে একইবারে শৈশব থেকে। তারপরও মা’র কোলে মাথা রেখে মুখে মুখে বাবা নামক শব্দটির রাজা-রানীর গল্পের মতো শুনেই বেড়ে ওঠেছিলাম ২৫ বছর আগে। ঠিক এরই মাঝে মাকেও হারালাম ১৯৯৪ সালের ২৫ মে।
এইভাবে কোন রকমভাবে বেড়ে ওঠেছি মিঞা ভাই (প্রয়াত মা-বাবার ৮ সহোদরের মধ্যে সবার বড়)-এর মায়া-মমতায়। তারপর ২০০৯ সালের ১২ জুন নতুন আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি একজন বিনয়ী আর সহজ সরল মনের মানুষের পরিবারে। যেখানে অভিভাবকের আদর-ভালোবাসার কমতি দেখেনি ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ২৮ ডিসেম্বর রাত ১০টার দিকে ঐ পরমপ্রিয় অভিভাবক (শ্বশুর আব্বাজান) কে হারালাম আল্লাহপাক রাব্বুল আল-আমীনের ইশারায়।
যেই মানুষটি অনন্তকালের জন্য পাড়ি জমিয়েছেন আসল ঠিকানায়। হ্যাঁ! তিনিই হলেন অত্যন্ত কোমলমতি হৃদয়ের প্রাণপ্রিয় মানুষ আব্বাজান (শ্বশুর)। প্রয়াত এই বাবাকেও বিশেষ দিনটিতে শুভেচ্ছা জানাতাম ব্যতিক্রমীভাবে। আজ এই সম্মানিত অভিভাবক শ্বশুর আব্বাজানকে খুবই মনে পড়ছে বাবা দিবসে। আমি আমার শ্বশুর আব্বাজানের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আল-আমীন যেন উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব দান করে। আমীন।
নতুন প্রজন্মের কাছে মা দিবস-বাবা দিবসের ধারণাগুলো দিন দিন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। গত শতাব্দীর প্রথমদিকে বাবা দিবস পালন শুরু হয়। আসলে মায়েদের পাশাপাশি বাবারাও যে তাদের সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল- এটা বোঝানোর জন্যই এ দিবস পালন শুরু। আজ বাঙালি সন্তানদের হৃদয়ে বাবা দিবসটি উৎসবে পরিণত হয়েছে। হাজার কষ্ট সয়ে তিলে তিলে যে সন্তানকে বড় করেছেন একজন বাবা, তাকে ঘিরেই এদিন হবে ব্যতিক্রমী উৎসব।
তবে বাবা কি শুধুই একটি বিশেষ দিনের জন্য! এরকম বিতর্ক থাকলেও এই বিশেষ দিনটিতে একটি ফুল অথবা একটি কার্ড নিয়ে শুভেচ্ছা জানালে বাবা তাতেই খুশি। বাবার চাহিদা এতটুকুই। ছোট-বড়, অখ্যাত-বিখ্যাত সকলের কাছেই বাবা অসাধারণ। বাবার স্নেহ-ভালোবাসা সকলেরই প্রথম চাওয়া আর পাওয়া। সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিন, মাস আর বছরের প্রতিক্ষণেই বাবাকে সম্মান দেবে সব সন্তানই। তাই আন্তর্জাতিক বাবা দিবসে সশ্রদ্ধা ভরে সালাম জানাই আমার বাবাকে।
আজ বাবা পৃথিবীতে নেই। সকল সন্তানরা যেন বাবা’ শব্দটিকে মূল্যায়ন করে। বৃদ্ধা কিংবা অসুস্থ থাকা বাবাকে কোন সন্তান যেন কষ্ট না দেয়, সেদিকে সবাই সজাগ থাকতে হবে। যেহেতু বাবা’র বিকল্প কিছুই নেই। ইতিহাস যাই হোক, দিনটির তাৎপর্য এখানে যে, এই দিনটিতে বাবা’কে বিশেষভাবে মনে করিয়ে দিয়ে, বাবা’কে ভালবাসার কথা স্মরণ, ভক্তি করা এবং বাবা’র প্রতি আমাদের কর্তব্যবোধ জাগিয়ে দিয়ে বরং আমাদেরই যেন লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল। শুধু বছরে এক দিন নয়, বছরের প্রতিটি দিন যেন আমরা বাবা’কে ভালবাসি, বাবাকে শ্রদ্ধা করি- আমরা যেন বাবা’র প্রতি ত্যাগ ও কর্তব্য কখনো ভুলে না যাই।
লেখক: আখতার-উজ-জামান (গবেষক, সাংবাদিক)