লন্ডন বৈঠকে প্রাধান্য পেতে পারে নির্বাচনের সময় নির্ধারণের বিষয়টি।
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন উপদেষ্টাদের কেউ কেউ।
ডিসেম্বরে সম্ভব না হলে নির্বাচনের জন্য ফেব্রুয়ারিকে উপযুক্ত মনে করেন খালেদা জিয়াও।
জাতীয় নির্বাচন কবে হবে, এ নিয়ে কয়েক মাস ধরে রাজনীতিতে যে অস্থিরতা বিরাজ করছিল, ভোটের সম্ভাব্য সময় ঘোষণায় সেটি আপাতত কমেছে। যদিও এপ্রিলে ভোটের ঘোষণাকে বিএনপি মেনে নেয়নি। ফলে ভোটের সময় নিয়ে বিতর্ক এখনো মেটেনি। এরই মধ্যে আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে শুক্রবার (১৩ জুন) লন্ডনে অনুষ্ঠেয় অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের সাক্ষাৎ বা বৈঠক।
এখন দেশের রাজনীতি-সচেতন সবার দৃষ্টি লন্ডনের এই বৈঠকের দিকে। বৈঠকে ভোটের দিনক্ষণ, সংস্কার, জুলাই সনদসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে কী বোঝাপড়া হয়, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা চলছে।
ঈদুল আজহার আগের দিন (৬ জুন) জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে যেকোনো দিন জাতীয় নির্বাচন হতে পারে। বিএনপিসহ অনেক দল এ ‘সময়সীমা’ মেনে না নিলেও ভোটের সম্ভাব্য সময় ঘোষণাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন রাজনৈতিক অঙ্গনের অনেকে। যদিও রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন, রোজার আগে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভোটের সময় নির্ধারণ করতে পারলে রাজনৈতিক বোঝাপড়া আরও স্বস্তিদায়ক হতো। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস চার দিনের সরকারি সফরে গতকাল মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে পৌঁছেছেন। এর আগেই মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্ভাব্য সাক্ষাতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বিএনপি ও সরকারি সূত্র। বিএনপি জানিয়েছে, আগামী শুক্রবার সকালে লন্ডনে এই সাক্ষাৎ হতে পারে।
রাজনৈতিক মহল এই সাক্ষাৎকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের সাক্ষাৎ ফলপ্রসূ হলে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এবং জুলাই সনদসহ আরও অনেক বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির যে দূরত্ব বা মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কমে আসতে পারে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, গত মে মাসের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাজ্য সফরের সময় চূড়ান্ত হয়। বিষয়টি জানার পর তখন থেকেই বিএনপি বিবেচনায় রেখেছিল; প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সৌজন্য সাক্ষাৎ হতে পারে কি না। এরই মধ্যে আদালতের রায় আসার পরও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে শপথ না পড়ানো, এটাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভে রাজধানীতে অচলাবস্থা তৈরি, এর রেশ ধরে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপির) সঙ্গে বিরোধে জড়ানোসহ সরকারের সঙ্গে একধরনের তিক্ততা তৈরি হয়। এমন একটা পরিস্থিতিতে ২৮ মে নয়াপল্টনে বড় সমাবেশ ডেকে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে বলে তারেক রহমান জোর দাবি জানান।
এরপর প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করেন; তাতে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব সন্তুষ্ট হতে পারেনি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লন্ডনে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে তারেক রহমানের সম্ভাব্য সৌজন্য সাক্ষাতের বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, এই সাক্ষাৎ যাতে হয়, এ ব্যাপারে সর্বশেষ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও ভূমিকা রাখেন। পরে দুই পক্ষের ইচ্ছায়, বিশেষ করে সরকারের দিক থেকে বাড়তি আগ্রহে সাক্ষাতের সময় নির্ধারণ হয়। এ বিষয়ে গত সোমবার রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়। তাঁরা এই সাক্ষাৎকে দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের জন্য হিতকর হবে বলে মনে করেন। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। তিনি একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ১৭ বছর ধরে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত রয়েছেন। আমরা মনে করি, সরকারের প্রধান ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎটা হওয়া উচিত এবং এটা রাজনৈতিক শিষ্টাচারেরও অংশ। এই সাক্ষাৎ না হলে নিন্দুকেরা বিরূপ সমালোচনার সুযোগ নিতে পারত।’
লন্ডনে অনুষ্ঠেয় এই সাক্ষাৎ নিয়ে দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যেও কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটাকে (সাক্ষাৎ) আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি। কারণ, ইন্টেরিম গভর্নমেন্টের প্রধানের সঙ্গে দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের ফাংশনাল প্রধানের সাক্ষাৎ হচ্ছে। আমরা আশা করি, আগামী জাতীয় নির্বাচন ও সংস্কারের বিষয়ে তাঁরা কথা বলবেন।’ অবশ্য জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলনসহ আরও কয়েকটি দল প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়কে স্বাগত জানিয়েছে। তারা বলেছে, এতে জাতি আশ্বস্ত হয়েছে।
এর মধ্যে জামায়াত ও এনসিপি মনে করে, জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার পর নির্বাচনের সময় ঘোষণা করা হলে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হতো। জামায়াত আশা করে, সংস্কার, বিচার (আওয়ামী লীগের) ও নির্বাচন—এ তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে এবং ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশকে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।