ইসলাম ধর্মে কোরবানির স্থান অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। প্রতি বছর পবিত্র ঈদুল আজহার সময় মুসলিম বিশ্বে কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা হয়। কোরবানির অর্থ হল আত্মত্যাগ; এটি মানব জীবনের অন্যতম মহান ইবাদত, যা ঈমানের পরিচয় বহন করে। কোরবানির মাধ্যমে একজন মুসলিম তার আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, ধৈর্য্য ও আত্মত্যাগের মনোভাব প্রকাশ করে। এই ইবাদত কেবল ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক ও মানবিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ইসলামের ইতিহাসে কোরবানির উত্পত্তি নবী ইবরাহিম (আঃ) এর সময় থেকে। আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,“অতঃপর সে যখন তার পিতার সাথে কাজ করার মত বয়সে উপনীত হল তখন ইবরাহীম বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবাহ করছি, এখন তোমার অভিমত কি, বল। সে বললঃ হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।” (সূরা আস-সাফফাত: ১০২) এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা নবী ইবরাহিম (আঃ) ও তাঁর পুত্রের মধ্যে মহান আত্মত্যাগের দৃশ্য তুলে ধরেছেন। ইবরাহিমের পুত্র নিজের বাবা ও আল্লাহর নির্দেশ মেনে নির্ভয়ে আত্মসমর্পণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এটি কোরবানির মূল শিক্ষা, যেখানে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের প্রিয়তমকে উৎসর্গ করার এক আদর্শ প্রতিষ্ঠা পায়। ইসলামী ঐতিহাসিক সূত্র অনুসারে, আল্লাহ ইবরাহিমের সন্তানের পরিবর্তে এক দুম্বা প্রেরণ করেন, যা থেকে পশু কোরবানির রীতি শুরু হয়।
কোরআনে আরও এক আয়াতে বলা হয়েছে, “আল্লাহর কাছে পৌঁছে না এগুলোর গোশত ও রক্ত; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া (খোদাভিরুতা)। এভাবেই তিনি সে সবকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর তাকবীর পাঠ করতে পারো, এজন্য যে, তিনি তোমাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন; সুতরাং তুমি সৎকর্মশীলদেরকে সুসংবাদ দাও।” (সূরা আল-হজ্বজ্ব: ৩৭) এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, কোরবানির প্রকৃত মূল্য বাহ্যিক পশু কোরবানি নয়, বরং ইবাদতের অন্তরগত আত্মার পবিত্রতা এবং আল্লাহর প্রতি ভীরুতা বা তাকওয়া। অর্থাৎ, কোরবানি যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যথাযথ হৃদয় ও উদ্দেশ্যে করা হয়, তখন তা গ্রহণযোগ্য হয়। এ কারণে ইসলামে ইবাদতের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “কোরবানির দিন কোরবানি করাই সবচেয়ে বড় ইবাদত।” (তিরমিজি, হাদিস : ১৪৯৩)
এবং তিনি আরও ইরশাদ করেছেন, “কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একেকটি করে নেকি দেওয়া হয়।” (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৯২৮৩) এই হাদিসসমূহ থেকে স্পষ্ট হয়, কোরবানির ফজিলত অসাধারণ। প্রতিটি ক্ষুদ্র উপাদান এবং পশুর প্রতি খরচকৃত পরিশ্রমের জন্য আল্লাহ পুরস্কৃত করেন। এটি একটি আত্মশুদ্ধির মাধ্যম, যা গুনাহ মোচনে বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং আল্লাহর নৈকট্যের পথ সুগম করে।
কোরবানি গ্রহণ হওয়ার মূল উপাদান তাকওয়া বা খোদাভিরুতা। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
“আল্লাহর দরবারে কোরবানির গোশত ও রক্ত কোনো কিছুই পৌঁছায় না, পৌঁছায় শুধু তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ, আয়াত-৩৭) এখানে তাকওয়া শব্দের অর্থ হলো আল্লাহর প্রতি ভীতি, ভক্তি ও আনুগত্যের সঙ্গে জীবন পরিচালনা। তাই কোরবানি কেবল বাহ্যিক আচরণ নয়, বরং অন্তরঙ্গ মনোভাব ও ঈমানের চূড়ান্ত প্রকাশ।
বাংলাদেশে কোরবানির গুরুত্ব শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি সামাজিক ঐক্য ও দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতির বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ কোরবানির পশু কোরবানি করে থাকেন। কোরবানির পশুর মাংস দরিদ্র, অসহায় ও খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষের মধ্যে বিতরণ করে সমাজে সাম্য ও সৌহার্দ্যের বন্ধন দৃঢ় হয়। জাতীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর কোরবানির সময় প্রায় ১০০ মিলিয়নেরও বেশি পশু কোরবানি করা হয়, যা দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে কোরবানির মাধ্যমে পারস্পরিক সাহায্য ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবছর কোরবানির মাংস দরিদ্র পরিবারের মধ্যে বিতরণ করে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয় এবং এলাকার মানুষদের মধ্যে একতা গড়ে ওঠে। তবে, কোরবানির সাথে সম্পর্কিত কিছু সমসাময়িক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সুষ্ঠু পশু নির্বাচনের অভাব, পরিবেশ দূষণ এবং পশু পাচারের অনিয়ম জাতীয় পর্যায়ে উদ্বেগের বিষয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, “কোরবানির পশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতি অবলম্বন করলে ইবাদত ও পরিবেশ দুটোই সুরক্ষিত থাকবে।” এই সমস্যা মোকাবেলায় সরকারের পক্ষ থেকে পরিবেশবান্ধব পশু কোরবানির নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে যা ধীরে ধীরে কার্যকর হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী মুসলিম সমাজে কোরবানির গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে বাংলাদেশে ধর্মীয় ঐতিহ্যের সাথে কোরবানি পরিণত হয়েছে এক সামাজিক ও অর্থনৈতিক উৎসব। এতে পশুপালন শিল্পের উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও উল্লেখযোগ্য অবদান থাকে। বাংলাদেশে প্রতিবছর ঈদুল আজহার সময় পশুপালন খাতে ৫ থেকে ৭ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয় বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
কোরবানির প্রকৃত মাহাত্ম্য বোঝার জন্য শুধু পশু কোরবানি করার বাইরে যাবতীয় মানবিক ও আধ্যাত্মিক দিকগুলো উপলব্ধি করতে হবে। কোরবানির মাধ্যমে যে দান, আত্মত্যাগ ও পারস্পরিক সহযোগিতার শিক্ষা দেয়া হয়, তা মানবজীবনের এক অমূল্য সম্পদ। এছাড়াও, এই ইবাদত মুসলিম সমাজে দারিদ্র বিমোচন ও মানবকল্যাণে বিশেষ অবদান রাখে। এজন্য কোরবানির পরবর্তী কার্যক্রম যেমন মাংস বিতরণ, পশু পালন ও পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।
সর্বোপরি, কোরবানির ইবাদত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রকৃত মানুষ হবেন সেই, যিনি নিজের স্বার্থের চেয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেন। আত্মত্যাগের এই মহাকাব্য আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা উচিত, যেন আমরা সত্যিকার অর্থে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারি। এই মহান ইবাদত আমাদের শুধু আল্লাহর কাছে নয়, সমাজের দরিদ্র ও অসহায়ের কাছে সহানুভূতি, ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ শেখায়।
অতএব, বাংলাদেশে প্রতিটি মুসলিম নাগরিকের উচিত কোরবানির মাহাত্ম্য অনুধাবন করে এ ইবাদতকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া এবং সামাজিক সম্প্রীতি ও মানবিক কল্যাণে এর প্রভাব বাড়ানো। কারণ কোরবানি শুধু পশু বলিদান নয়, এটি ঈমানের এক অনন্য প্রদর্শনী, যা আমাদের মানবতা ও ধর্মীয় দায়িত্বের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে।
সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং
হাবীবুল্লাহ্ বাহার কলেজ, ঢাকা।
মোবাইল নং ০১৫৫৮০২৪৭৮৬, ০১৮৬৯২৫৭৯৫৭
ইমেইলঃ t34442@nu.ac.bd