ভুয়া কোম্পানি খুলে জালিয়াতির মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক থেকে সাড়ে ৯০০ কোটি টাকা নিয়েছে এস আলম ও নাবিল গ্রুপ। এর মধ্যে এস আলম পেয়েছে ৪০০ কোটি এবং নাবিল গ্রুপ পেয়েছে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা। ব্যাংকের সঙ্গে যোগসাজশে ২০২২ সালে এই জালিয়াতি করেছে গ্রুপ দুটি। আর এই অভিযোগে বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা হয়েছে। সর্বশেষ গত ৮ এপ্রিল পর্যন্ত সুদ-আসল মিলিয়ে কথিত এই গ্রাহকের কাছে ব্যাংকের পাওনা এক হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। মামলার বাদী ইসলামী ব্যাংক গুলশান শাখা। মামলার আইনজীবী এম অ্যান্ড এন অ্যাসোসিয়েটসের চেম্বার প্রধান ব্যারিস্টার এসএম মইনুল করিম যুগান্তরকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে এই টাকা নিয়েছেন। আর টাকার মালিক ব্যাংকের আমানতকারী। তার মতে, এ ধরনের ঘটনায় ব্যাংককে আরও সচেতন হতে হবে। কারণ জালিয়াতির মাধ্যমে একবার টাকা আত্মসাৎ হলে তা আদায় করা কঠিন।
মামলার বিবরণ থেকে জানা গেছে, ইসলামী ব্যাংকের গুলশান-১ শাখা থেকে ২০২২ সালের ১৯ জুলাই ৯৫০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে ‘মার্কেট মাস্টার অ্যানালাইজার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। সেখানে বলা হয়, এটি ট্রেডিং কোম্পানি। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। পুরোটাই ভুয়া। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শাহ আলম। তিনি নাবিল গ্রুপের মালিক ও বর্তমান এমডি আমিনুল ইসলামের আপন মামা। এছাড়াও তিনি নাবিল গ্রুপের কর্মচারী। কোম্পানির নামে নেওয়া ৯৫০ কোটি টাকা ঋণের ৪০০ কোটি টাকা বিতরণ হয় ২০৫০২৭৬৪৯০০৩৬৭৬১৭ নম্বর অ্যাকাউন্টে। এর সুবিধাভোগী এস আলম। ৫৫০ কোটি টাকা যায় ২০৫০২৭৪৯০০৩৬৭৭১৮ নম্বর অ্যাকাউন্টে। এই অর্থের সুবিধাভোগী রাজশাহীভিত্তিক নাবিল গ্রুপ। কোনো ধরনের জামানত ছাড়াই এই ঋণ দেন ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুল মাওলা এবং বিনিয়োগ ইনচার্জ মেফতা উদ্দিন।
বিবরণে আরও বলা হয়, মামলার আসামি মো. শাহ আলম ২০২২ সালের ১৪ জুলাই ইসলামী ব্যাংকের গুলশান শাখায় ‘মার্কেট মাস্টার অ্যানালাইজার লিমিটেড’-এর নামে একটি ঋণের আবেদন করেন। ঘটনার পাঁচ দিন পর ১৯ জুলাই একই শাখায় প্রতিষ্ঠানটির নামে ২০৫০২৭৬০১০০ ১৮৩৮০৩ নম্বর হিসাব খোলা হয়। এই হিসাবের ধরন ‘আল-ওয়াদিয়া’ কারেন্ট অ্যাকাউন্ট। এরপর ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রতিষ্ঠানটির নামে ৯৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয়। প্রধান কার্যালয় এই ঋণের অনুমোদন দেয় ওই বছরের ৮ আগস্ট। শাখা থেকে অর্থ ছাড় করা হয় ১০ আগস্ট। ঋণের ধরন এলটিআর বা আস্থার ভিত্তিতে ঋণ। এর মেয়াদ ছিল এক বছর। কিন্তু পরবর্তী এক বছরে কোনো কিস্তি পরিশোধ হয়নি। এরপর আসামিদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ৯ নভেম্বর পাওনা টাকার ২ দশমিক ৫০ শতাংশ হিসেবে ২৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণটি পুনঃতফসিল করা হয়। পুনঃতফসিলের মেয়াদ ছিল সাত বছর। গ্রেস পিরিয়ড ছিল এক বছর। ঋণের শর্ত ছিল তারা মুনাফাসহ কিস্তি পরিশোধ করবে। কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কিন্তু পরবর্তীতে আর কোনো অর্থ পরিশোধ করা হয়নি। ফলে গত ৮ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির কাছে মূল অর্থ, মুনাফা এবং ক্ষতিপূরণসহ ব্যাংকের পাওনা দাঁড়ায় এক হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে মুনাফা ৮৩ কোটি এবং জরিমানা ১৩৫ কোটি টাকা রয়েছে।
মোট টাকার মধ্যে ২০৫০২৭৬৪৯০০৩৬৭৬১৭ নম্বর অ্যাকাউন্টের বিপরীতে পাওনা ৫৪১ কোটি ১৬ লাখ টাকা এবং ২০৫০২৭৪৯০০৩৬৭৭১৮ নম্বর অ্যাকাউন্টের বিপরীতে পাওনা ৬০২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এই টাকা পরিশোধ না করার অভিযোগে বৃহস্পতিবার অর্থঋণ আদালত-৪ এ মামলা করা হয়। মামলা নং ১৯৬/২০২৫। মামলায় আসামি করা হয়েছে মূল কোম্পানি ‘মার্কেট মাস্টার অ্যানালাইজার, প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহ আলম, চেয়ারম্যান মো. শরিফুল ইসলামকে।
বিবরণে আরও বলা হয় কোম্পানিটি অস্তিত্বহীন ও ভুয়া। কোম্পানির এমডি নাবিল গ্রুপের কর্মচারী। এ ছাড়াও তিনি নাবিল গ্রুপের এমডি আমিনুল ইসলাম স্বপনের আপন মামা। তবে এ ব্যাপারে মো. শাহ আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া মেলেনি।
এস আলমের ২৬১৯ কোটি টাকা অবরুদ্ধের আদেশ : ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্টদের নামে থাকা এক হাজার ৩৬০টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এসব হিসাবে দুই হাজার ৬১৯ কোটি সাত লাখ ১৬ হাজার টাকা রয়েছে। বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন গালিবের আদালত দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম জানান, দুদকের উপ-পরিচালক তাহাসিন মুনাবীল হক এ আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত আবেদনটি মঞ্জুর করেন।
আবেদনে বলা হয়েছে, অনুসন্ধানে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, সাইফুল আলমের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি/স্বত্বাসমূহ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার বিভিন্ন হিসাবের অর্থ অন্যত্র হস্তান্তর, স্থানান্তর বা বেহাত করার চেষ্টা করছেন। অনুসন্ধান নিষ্পত্তির পূর্বে সম্পদ হস্তান্তর বা স্থানান্তর হয়ে গেলে পরবর্তীতে টাকা উদ্ধার করা দুরূহ হয়ে পড়বে। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে ব্যাংক হিসাবসমূহ অবরুদ্ধ করা একান্ত আবশ্যক। এর আগে গত ৭ অক্টোবর এস আলম ও তার স্ত্রী ফারজানা পারভীনসহ তার পরিবারের ১২ সদস্যের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত।