রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারিতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হন। আজ এই জোড়া খুনের ১৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে। তবে এত বছর পরও হত্যার রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি।
গত ছয় বছর ধরে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) মামলাটির তদন্ত করলেও কোনো সাফল্য পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি মামলাটির তদন্তভার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) গ্রহণ করেছে এবং নতুন করে তদন্ত শুরু করেছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল র্যাব মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায়। তদন্তকালে রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমান, বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবিরসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া, হত্যায় ব্যবহৃত ছুরি, বঁটি, সাগরের হাত বাঁধা ওড়না, রুনির পরনের কাপড়সহ বিভিন্ন জিনিস ডিএনএ পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। তবে এসব পরীক্ষা থেকে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। র্যাবের তদন্তে ১৬০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করা যায়নি।
মামলার নথিপত্র বিশ্লেষণ করে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সর্বশেষ গত বছরের ১৫ অক্টোবর মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমার দিন ধার্য ছিল। কিন্তু প্রতিবেদন জমা দেয়নি র্যাব। র্যাবের তদন্তকালে প্রতিবেদন জমার তারিখ পেছায় ১১২ বার।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হবে। পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, ‘তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি এ বিষয়ে ইতিবাচক তথ্য দিতে পারব বলে আশা করছি।’
দুই বছর পর ২০১৪ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ওই সময় তিনি হত্যার রহস্য উন্মোচনের সুনির্দিষ্ট তারিখও ঘোষণা করেছিলেন।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সাগর ও রুনির হত্যাকাণ্ডের সময় বাসায় ছিল তাঁদের একমাত্র সন্তান সাড়ে চার বছর বয়সী মিহির সরওয়ার মেঘ। এখন সে এ লেভেল পাস করেছে। হত্যার ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যা মামলা করেন। প্রথমে এ মামলা তদন্ত করছিল শেরেবাংলা নগর থানা–পুলিশ। চার দিন পর মামলার তদন্তভার ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ৬২ দিনের মাথায় ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এরপর আদালত র্যাবকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশে গত ৪ নভেম্বর র্যাবের কাছ থেকে মামলার নথিপত্র বুঝে নেয় পিবিআই। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আজিজুল হক।
এর আগে গত বছরের ২৩ অক্টোবর এ মামলার তদন্তে চার সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। টাস্কফোর্সকে মামলার তদন্ত ছয় মাসের মধ্যে শেষ করে হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
সূত্র জানায়, তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর পিবিআই নথিপত্র নিয়ে বিশ্লেষণ ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তারা তদন্ত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগার থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রুনিকে পেছন থেকে ডান হাত দিয়ে পেটের ডান পাশে কোপ দেওয়া হয়েছে। তাঁর পরনের টি–শার্টে ওই ব্যক্তির ডিএনএ পাওয়া গেছে। সবুজ রঙের ওড়না দিয়ে সাগরের হাত–পা বাঁধা ছিল। সেখানে আরেকজনের ডিএনএ পাওয়া গেছে। পিবিআই এখন অজ্ঞাতপরিচয় ওই দুই ব্যক্তির ডিএনএ মেলাতে সন্দেহভাজনদের খুঁজছে।
পিবিআই জানায়, সাগর-রুনির সঙ্গে কারও ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সম্পত্তিগত, পেশাগত শত্রুতার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তাদের সঙ্গে কারও বিরোধ ছিল না। তারা কর্মজীবনে কখনো হুমকি পাননি। গ্রেপ্তার তানভীর সাংবাদিক রুনির পূর্বপরিচিত হলেও তিনি খুনের সঙ্গে জড়িত নন।
সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত এখন পিবিআইয়ের হাতে। নতুন করে তদন্ত শুরু হলেও হত্যার রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে কিনা, তা এখনও অনিশ্চিত। পরিবার ও সমাজের পক্ষ থেকে এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার পাওয়ার দাবি অব্যাহত রয়েছে।