কানাডা, মেক্সিকো ও চীনের পণ্যে ট্রাম্প প্রশাসন বাড়তি শুল্ক আরোপ করায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে। এ সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
অবশ্য রপ্তানিমুখী শিল্পে উপযুক্ত নীতিসহায়তা না দেওয়া হলে রপ্তানি সম্ভাবনার পুরোটাই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দখলে চলে যেতে পারে। এর কারণ, ভারত সরকার ইতোমধ্যে রাজ্যভেদে বস্ত্র খাতে বড় অঙ্কের কর রেয়াত, নগদ সহায়তাসহ নীতিসহায়তার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে।
অর্থনীতিবিদ এবং এ খাতের কয়েকজন ব্যবসায়ী যুগান্তরের কাছে এমন মন্তব্য করেছেন।
শনিবার পৃথক ৩টি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কানাডা ও মেক্সিকোর পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ এবং চীনের পণ্যে বর্তমান হারের অতিরিক্ত আরও ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। আজ থেকে এ আদেশ কার্যকর করার কথা রয়েছে। এতদিন বাণিজ্যচুক্তির আওতায় কানাডা ও মেক্সিকো আমেরিকায় বিনা শুল্কে বা কম শুল্কে পণ্য রপ্তানি করতে পারত। এর আগে প্রথম মেয়াদেও ট্রাম্প চীনের পণ্যে বাড়তি শুল্ক আরোপ করে।
বাংলাদেশ নিট পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে আছে। ট্রাম্প প্রশাসন কানাডা, মেক্সিকো ও চীনের পণ্যে শুল্ক বাড়ানোয় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন হয়েছে। এ সুযোগ নিতে এখনই সরকারকে সময়োপযোগী নীতি গ্রহণ করা উচিত। দেরি করলে বিনিয়োগ-ব্যবসা সবই পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যাবে।
কারণ, ভারত ইতোমধ্যে বস্ত্র খাতে মেগা পরিকল্পনা নিয়ে এ বাজার ধরতে মাঠে নেমেছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রপ্তানি আরও বাড়াতে কূটনীতিকদের সোচ্চার হতে হবে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চাহিদা মেটাতে গার্মেন্টস মালিকরা যাতে উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারেন, সেজন্য নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি এবং এলসি খোলার প্রয়োজনীয় ডলারের সংস্থান করতে হবে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, আমেরিকা-চীন-কানাডা-মেক্সিকোর বাণিজ্যযুদ্ধে বাংলাদেশের লাভবান হওয়া এবং বিনিয়োগ আকর্ষণের খুব সম্ভাবনা ছিল। বিশেষত চীন জুতার কারখানাগুলো স্থানান্তরের উদ্যোগ ইতোমধ্যে গ্রহণ করেছে। এ কারখানাগুলোর একমাত্র গন্তব্য বাংলাদেশ হতে পারত।
কিন্তু সরকার তো বাংলাদেশের কারখানাগুলোরই জোগান দিতে পারছে না। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে রপ্তানিমুখী কারখানাগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দ্বিগুণ করা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা আরও কমানো হয়েছে। এ কারণে নসিবে থাকার পরও বাংলাদেশের সুবর্ণ সুযোগ হারিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায় নীতিসহায়তা দিতে সরকার একটি কমিটি করেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বস্ত্র খাত বাংলাদেশের প্রধানতম শিল্প খাত হলেও এ খাতের কাউকে সরকারি কমিটিতে রাখা হয়নি। তাহলে সরকার কীভাবে নীতিসহায়তা দেবে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের ৫ আগস্ট পতনের পর বস্ত্র খাত ঘিরেই সব চক্রান্ত হয়েছে। নাশকতাও করতে চেয়েছিল দুর্বৃত্তরা। এসব কারণে এ খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, বাণিজ্যযুদ্ধে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। তবে যতই সম্ভাবনা থাকুক না কেন, সেটা কাজে লাগানো যাবে না, কেননা নীতিনির্ধারকরা চান না সেই ব্যবসা বাংলাদেশে আসুক।
এর যুক্তি হিসাবে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরামর্শে সরকার যেসব নীতি গ্রহণ করেছে, এর পুরোটাই ব্যবসা-বাণিজ্যকে সংকুচিত করবে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে শ্রমিকদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, বাড়ানো হয়েছে ব্যাংক ঋণের সুদহার, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে, ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সংকুচিত করা হয়েছে-এসব সিদ্ধান্তের কোনোটাই ব্যবসাবন্ধব নয়। এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। তাই বাণিজ্যযুদ্ধের সুফল বাংলাদেশ নিতে চায় কি না, সেটি আগে সরকারকে ঠিক করতে হবে। তারপর সে অনুযায়ী নীতি গ্রহণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বাণিজ্যযুদ্ধের আঁচ করতে পেরে গত বছরই ভারত টেক্সটাইল খাতে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছে। রাজ্যভেদে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিয়ে দিচ্ছে, জমি অধিগ্রহণে ব্যবসায়ীদের সহায়তা করছে। আর বাংলাদেশ করছে ঠিক এর উলটোটা।
প্রসঙ্গত, গত সেপ্টেম্বরে ভারত তাদের বস্ত্রশিল্পের জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করে। সেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে বস্ত্র খাতে বিনিয়োগ ৩৫ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনার কথা জানান দেশটির বস্ত্রমন্ত্রী গিরিরাজ সিং। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কার্যক্রমের আওতায় ভারত এ সময়ের মধ্যে বস্ত্রশিল্পে সাড়ে চার কোটি থেকে ছয় কোটি কর্মসংস্থান তৈরির পরিকল্পনা করেছে। পরিকল্পনার অংশ হিসাবে রাজ্যভেদে ভারত টেক্সটাইল শিল্প স্থাপনে প্রণোদনা দিচ্ছে।
যেমন মহারাষ্ট্রে নতুন শিল্প স্থাপনে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ এবং শিল্প সম্প্রসারণে ১৫ শতাংশ মূলধন সহায়তা দেওয়া হয়। আর গুজরাটে ৩০ শতাংশ এবং অন্ধ্রপ্রদেশে গ্রিন কারখানা স্থাপনে ৫০ শতাংশ দেওয়া হয়। আবার গুজরাটে ১০ বছরের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদ ৭ শতাংশ, অন্ধ্রপ্রদেশে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হয়। গুজরাটে টেক্সটাইল পার্কে বিনিয়োগ করলে ২৫ শতাংশ বিশেষ সহায়তা দেওয়া হয়। একইভাবে গুজরাটে বিদ্যুতে ইউনিটপ্রতি ২ রুপি, অন্ধ্রপ্রদেশে ১-২ রুপি এবং বিহারে ২ রুপি অনুদান হিসাবে দেওয়া হয়। জমি অধিগ্রহণে অন্ধ্রপ্রদেশে মোট প্রকল্পের ৫ শতাংশ বা জমির মূল্যের ৫০ শতাংশ, মহারাষ্ট্রে স্ট্যাম্প ডিউটি মওকুফ, তামিলনাড়ুতে জমির দামে ৫০ শতাংশ প্রণোদনা হিসাবে দেওয়া হয়।
ভারতে কোনো টেক্সটাইল মিল ৫ কোটি ডলার রপ্তানি করলে শুধু সহায়তা (রোডট্যাপ, ডিউটি ড্র ব্যাক, ফ্রেইট গ্রান্ট) হিসাবে ৩২ লাখ ডলার সাবসিডি হিসাবে পায় এবং বিদ্যুতে প্রণোদনা পায় ৯০ লাখ রুপি।
অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধে বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। চীনের তৈরি পোশাকের ওপর শুল্ক বাড়ানোয় স্বল্পমেয়াদে বিদেশি ক্রেতারা এবং চীনের পোশাক উৎপাদকরাও বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকতে পারেন। মধ্যমেয়াদে চীনের পোশাক উৎপাদকরা বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করতে পারেন। যেমনটি তারা করেছিল ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া ‘যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডা চুক্তির ফলে। এ চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শূন্য শুল্ক সুবিধা ভোগ করতে চীনা উদ্যোক্তারা মেক্সিকোর টেক্সটাইল ও পোশাক খাতে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ করেন।
নতুন বিনিয়োগ পেতে বাংলাদেশকে সংস্কারের মাধ্যমে বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি তৈরি পোশাক ব্যতীত অন্য শিল্পের সক্ষমতা প্রমাণ দিতে হবে। অবশ্য বাণিজ্যযুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদে চলতে থাকলে সেটি পুরো বিশ্বের জন্যই ক্ষতিকর হবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, একক দেশ হিসাবে বাংলাদেশ আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমেরিকায় বাংলাদেশ প্রায় ৭৬০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৭ শতাংশের বেশি। আমেরিকায় বাংলাদেশ তৈরি পোশাক বেশি রপ্তানি করে থাকে।
অন্যদিকে ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৬৭৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। এ সময় চীন যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজার ৫২২ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে।