স্টার্টআপ খাতের জন্য ২০২১ সালের মার্চে দুটি তহবিল গঠন করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর তিন বছরে তহবিলে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার বেশি জমা হয়। তবে এখন পর্যন্ত স্টার্টআপ কোম্পানিগুলোর মাঝে বিতরণ করা হয়েছে ৩৫ কোটি ২০ লাখ টাকা।
স্টার্টআপ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাবে দেশের স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম বাড়াতে পারছে না। অথচ এ জন্য আলাদা তহবিল থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত ঋণ নিতে পারছেন না উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, স্টার্টআপ খাতের জন্য ২০২১ সালের ২৯ মার্চ দুই ধরনের তহবিল গঠন করা হয়। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন তহবিল। দ্বিতীয়টি, ৫২টি তফসিলি ব্যাংকের মুনাফার ১ শতাংশ অর্থে গঠিত ব্যাংকগুলোর নিজস্ব স্টার্টআপ তহবিল। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তফসিলি ব্যাংকের মুনাফার অর্থ দিয়ে তৈরি এ তহবিলের মোট আকার দাঁড়ায় ৫০৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। দুটি তহবিল মিলিয়ে মোট অর্থের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার বেশি।
তহবিল দুটি গঠনের সময় বলা হয়েছিল, ব্যাংকগুলোর নিজস্ব তহবিলের সব অর্থ বিতরণ শেষ হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন তহবিল থেকে অর্থ নিয়ে স্টার্টআপদের মাঝে বিতরণ করতে পারবে। কিন্তু নিজস্ব তহবিলের ওই অর্থই ঠিকভাবে খরচ করতে পারেনি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১৫৯টি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানের মাঝে নিজস্ব তহবিল থেকে মাত্র ৩৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। সেই হিসাবে স্টার্টআপ খাতের জন্য ৯৬৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা এখনো তহবিলে পড়ে রয়েছে। আর ২০২৪ সালে ব্যাংকগুলোর মুনাফার ১ শতাংশ তহবিলে যোগ হলে এই অর্থের পরিমাণ আরও বাড়বে।
তহবিল বড়, ঋণ ছোট
২০২১ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগের পর বেশ কয়েকটি ব্যাংক এই খাতের জন্য বড় অঙ্কের তহবিল গঠন করে। যেমন ২০২৩ সাল পর্যন্ত স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ৬১ কোটি ১৬ লাখ টাকা, এইচএসবিসি ব্যাংক ২৫ কোটি ৬ লাখ টাকা, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ২৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ও ব্র্যাক ব্যাংক ২৩ কোটি ১৫ লাখ টাকার তহবিল গঠন করে। এ ছাড়া ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ইস্টার্ণ ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংকের তহবিলও ২০ কোটি টাকার ওপরে। বাকি সব ব্যাংকই কমবেশি এ তহবিল গঠন করেছে।
তবে তহবিল গঠন করলে কোনো ব্যাংকই স্টার্টআপদের মধ্যে আশানুরূপ ঋণ বিতরণ করতে পারেনি। সর্বোচ্চ ঋণ বিতরণকারীর পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে থাকা ইস্টার্ণ ব্যাংক ৫ কোটি ৮০ লাখ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ৪ কোটি ২৮ লাখ, সিটি ব্যাংক ৩ কোটি ৪৪ লাখ, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ২ কোটি ৬০ লাখ ও ব্র্যাক ব্যাংক ২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এ খাতে এক টাকাও ঋণ বিতরণ করেনি, এমন ব্যাংকের সংখ্যা ১৯। ঋণ বিতরণে পিছিয়ে রয়েছে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোও।
বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে ৯০ শতাংশের বেশি স্টার্টআপের ব্যর্থ হওয়ার নজির রয়েছে। এ কারণে স্টার্টআপ অর্থায়ন নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আগ্রহ বা কার্যক্রম কম
অন্যদিকে এখন পর্যন্ত ১৫৯টি স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান ঋণ পেলেও বেশির ভাগের ঋণের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। যেমন সোনালী ব্যাংক মোট ৪৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৮৬ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। অর্থাৎ একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ঋণ পেয়েছে ২ লাখ টাকা। এ খাতের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ ৫০ লাখ টাকার নিচে। শুধু হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এক কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে।
স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘স্টার্টআপ খাতের জন্য ৫০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে, অথচ ১০ শতাংশের বেশি বিতরণ হয়নি—এটা খুবই হতাশার। এই সামান্য অর্থ পুরো স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের উন্নয়নে কোনো কাজে আসছে না। দেশের স্টার্টআপ খাতকে এগিয়ে নিতে হলে তহবিলের আকার ও বিতরণের পরিমাণ দুটোই বাড়াতে হবে।’
তহবিল থাকার পরও কাঙ্ক্ষিত ঋণ বিতরণ না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে ৯০ শতাংশের বেশি স্টার্টআপের ব্যর্থ হওয়ার নজির রয়েছে। এসব উদ্যোগে ব্যাংকের অর্থায়ন শেষ পর্যন্ত মন্দ ঋণে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এ কারণে স্টার্টআপ অর্থায়ন নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আগ্রহ বা কার্যক্রম কম।
জটিলতা কোথায়
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, স্টার্টআপ অর্থায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যেমন এই তহবিল থেকে ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ১ কোটি টাকা। এ কারণে ভালো স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানকেও ১ কোটি টাকার বেশি ঋণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে স্টার্টআপ উদ্যোক্তার বয়সসীমা সর্বোচ্চ ৪৫ বছর। লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন দেওয়া কিংবা জামানত বা ব্যক্তিগত গ্যারান্টির মতো বিভিন্ন বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এসব কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান তহবিল থেকে ঋণ নিতে পারেনি।
তহবিলের ১০ শতাংশের বেশি বিতরণ হয়নি, এটা খুবই হতাশার। দেশের স্টার্টআপ খাতকে এগিয়ে নিতে হলে তহবিলের আকার ও বিতরণের পরিমাণ দুটোই বাড়াতে হবে
স্টার্টআপ খাতের বিভিন্ন অংশীজন নিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কার্যালয়ে ৬ জানুয়ারি এক মতবিনিময় সভা হয়। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানান, স্টার্টআপ খাতটি খুবই চ্যালেঞ্জিং এবং তা বাণিজ্যিক ব্যাংকের জন্য সুবিধাজনক নয়। ৫০৫ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ৩৫ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এটা একটা ব্যর্থতা।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার স্টার্টআপ খাতের জন্য নতুন বিনিয়োগের সুযোগ তৈরির কাজ করছে বলে জানান গভর্নর। তিনি বলেন, অভিজ্ঞ ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্টদের নিয়ে একটা ছোট প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হবে। সেটির মাধ্যমে তহবিলের অর্থ বিতরণ করা হবে। এই অর্থ ঋণ আকারে নয়, ইকুইটি আকারে দেওয়া হবে।
তবে স্টার্টআপ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠিত অনেক স্টার্টআপ ইকুইটি নিতে আগ্রহী হবে না। আবার ইকুইটি নেওয়ার বিষয়টি বেশ সময়সাপেক্ষও। তাই ঋণ ও ইকুইটি—দুই পদ্ধতিই থাকা উচিত।