বাবার পথ ধরে ছেলেও ফুটবলার হয়েছেন—এমনটা হরহামেশাই দেখা যায়। দেখা গেছে একই পরিবারের একাধিক ভাইকেও ফুটবল খেলে বিখ্যাত হতে। কিন্তু দাদা-বাবা-নাতি—তিন প্রজন্মই ফুটবলার এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলেছেন, এমন ঘটনা একটু বিরলই। ফুটবল ইতিহাসে সেই বিরল ঘটনার জন্ম দিতে পেরেছে যে পরিবারগুলো, ক্লাইভার্ট পরিবার তার মধ্যে একটি। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত যে জন, সেই ডাচ কিংবদন্তি প্যাট্রিক ক্লাইভার্ট সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া জাতীয় দলের কোচ হয়েছেন। এই সুযোগে তাঁর বাবা কেনেথ ক্লাইভার্ট এবং দুই সন্তান জাস্টিন ও রুবেন ক্লাইভার্টের ফুটবলার হওয়ার গল্পও জেনে নেওয়া যাক। পাশাপাশি থাকছে তিন প্রজন্মের আরও কিছু ফুটবল পরিবারের গল্পও
ক্লাইভার্ট পরিবার
প্রথম প্রজন্ম: কেনেথ ক্লাইভার্ট
দ্বিতীয় প্রজন্ম: প্যাট্রিক ক্লাইভার্ট
তৃতীয় প্রজন্ম: জাস্টিন ক্লাইভার্ট, রুবেন ক্লাইভার্ট
একসময়ের ডাচ উপনিবেশ সুরিনামেও ক্যালকাটা বলে একটা শহর আছে। নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে একটা সময় ভারতের কলকাতা (তৎকালীন ক্যালকাটা) থেকে অনেকে সুরিনাম গিয়ে স্থায়ী হয়েছেন। সে জন্যই কলকাতার নামে সুরিনামের ওই শহরেরও নাম রাখা। আর সেই ক্যালকাটাতেই কেনেথ ক্লাইভার্টের জন্য।
হ্যাঁ, পদবি দেখে যা ধারণা করছেন, তা-ই। তিনি ডাচ কিংবদন্তি প্যাট্রিক ক্লাইভার্টের বাবা। ছেলের মতো বাবা অবশ্য এত বিখ্যাত হতে পারেননি। সুরিনামের বিখ্যাত ক্লাব রবিনহুডে খেলছেন, প্রতিনিধিত্ব করেছেন জাতীয় দলেরও। এডউইন শাল ও গেরিত নিকোপের সঙ্গে মিলে তিনি গড়েছিলেন রবিনহুডের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর আক্রমণভাগের ত্রিফলা।
১৯৭০ সালে কেনেথ নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে থিতু হন পরিবার নিয়ে। এর ছয় বছর পরেই ক্লাইভার্টের জন্ম। সাত বছর বয়সে আয়াক্স একাডেমিতে যোগ দেওয়া ক্লাইভার্টের মূল দলে অভিষেক ১৮ বছর বয়সে, ১৯৯৪ সালে। পরের বছরই চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে মিলানের বিপক্ষে তাঁর সেই বিখ্যাত গোল, যে গোল আয়াক্সকে এনে দেয় ইউরোপ–সেরার ট্রফি।
আয়াক্সের হয়ে ক্লাব ফুটবলের প্রায় সব শিরোপা জেতার পর মিলানে এক বছর কাটিয়ে ১৯৯৮ সালে যোগ দেন বার্সেলোনায়, গড়ে ওঠে ব্রাজিল কিংবদন্তি রিভালদোর সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত জুটি। লা লিগা জিতেছেন ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে, বার্সেলোনার হয়ে ২৫৭ ম্যাচে করেছেন ১২২ গোল।
নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলে খেলেছেন ১৯৯৪ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত, ৭৯ ম্যাচে ৪০ গোল করে দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতাও তিনি। তাঁর সময়েই ১৯৯৮ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলেছিল নেদারল্যান্ডস। পেলের করা জীবিত সেরা ১২৫ ফুটবলারের একজন হিসেবেও জায়গা পান ক্লাইভার্ট। খেলা ছাড়ার পর কোচ হয়েছেন। সেখানে অবশ্য খুব একটা সফল নন, তবে ফুটবল ব্যবস্থাপক হিসেবে ক্লাইভার্ট আবার খেলোয়াড়ি জীবনের মতোই উজ্জ্বল। আয়াক্স একাডেমির দায়িত্বে ছিলেন, কাজ করেছেন পিএসজির ফুটবল পরিচালক ও বার্সেলোনার একাডেমির পরিচালক হিসেবেও।
দাদা কেনেথের অর্জন ছাড়িয়ে গেছেন বাবা প্যাট্রিক। কিন্তু প্যাট্রিককে কি ছাড়াতে পারবেন ছেলে জাস্টিন ক্লাইভার্ট কিংবা রুবেন ক্লাইভার্ট? ১৯ বছর বয়সী রুবেনকে নিয়ে অবশ্য এত প্রত্যাশা নেই অনেকের। আপাতত খেলছেন ডাচ দ্বিতীয় সারির লিগের দল উট্রেখটের ডিফেন্ডার হিসেবে। তবে প্যাট্রিকের মতোই জাস্টিনের ক্যারিয়ার শুরু আয়াক্সের বিখ্যাত একাডেমিতে। ২০১৬ থেকে ২০১৮, এই দুই বছর আয়াক্সের মূল দলে খেলার পর পাড়ি জমান ইতালিতে। শোনা যায়, রোমার কিংবদন্তি ফ্রান্সেস্কো টট্টি নাকি ফোন করে বন্ধু প্যাট্রিক ক্লাইভার্টকে বলেছিলেন, তোমার ছেলেকে আমাদের ক্লাবে চাই। রোমার হয়ে আলো ছড়াতে শুরু করেছেন, এরই মধ্যে চ্যাম্পিয়নস লিগে ইতালিয়ান ক্লাবটির হয়ে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা হিসেবে রেকর্ড গড়েছেন। এরই মধ্যে ডাক পেয়েছেন নেদারল্যান্ডস জাতীয় দলেও। তবে বাবা প্যাট্রিকের কীর্তি ছুঁতে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে জাস্টিনকে।
গুদিয়নসন পরিবার
প্রথম প্রজন্ম: আরনর গুদিয়নসন
দ্বিতীয় প্রজন্ম: এইদুর গুদিয়নসন, আরনর বর্গ
তৃতীয় প্রজন্ম: সভেইন অ্যারন গুদিয়নসন, আন্দ্রি, ড্যানিয়েল ট্রিস্টান
২৪ এপ্রিল ১৯৯৬, এস্তোনিয়ার বিপক্ষে আইসল্যান্ডের ম্যাচ। বিরতির পর আইসল্যান্ডের ৩৪ বছর বয়সী আরনর গুদিয়নসনের বদলি হিসেবে নামলেন ১৭ বছর বয়সী এইদুর গুদিয়নসন। আর তাতেই লেখা হলো ইতিহাস। বাবা-ছেলে দুজনেই একই আন্তর্জাতিক ম্যাচে খেলার ঘটনা ফুটবল ইতিহাসে এটাই এখন পর্যন্ত একমাত্র। যদিও একজন অন্যজনের বদলি হিসেবে নামায় দুজন একসঙ্গে মাঠে ছিলেন না।
এটা নিয়ে আক্ষেপের কমতি ছিল না আরনরের। তাঁর বয়স যখন ২৫, তখনই একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ছেলে এইদুরের সঙ্গে একই ম্যাচে খেলবেন, এটা তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ইচ্ছা। ইচ্ছাপূরণের সুযোগ এস্তোনিয়ার বিপক্ষে ওই ম্যাচের আগেও এসেছিল। কিন্তু বয়সভিত্তিক একটা টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়ে অ্যাঙ্কেল ভেঙে দুই মৌসুম মাঠের বাইরে ছিলেন এইদুর। চোট কাটিয়ে ফেরার পর জাতীয় দলে অভিষেক, বাবা-ছেলে অবশেষে একই ম্যাচে খেললেন, কিন্তু একজন অন্যজনের বদলি হিসেবে।
বাবা-ছেলে দুজনেই একই আন্তর্জাতিক ম্যাচে খেলার ঘটনা ফুটবল ইতিহাসে এটাই এখন পর্যন্ত একমাত্র।
ফুটবলার হিসেবে এইদুরের ক্যারিয়ারই বেশি বর্ণাঢ্য। ১৯৯৪ সালে আইসল্যান্ডের ক্লাব ভালুরের হয়ে অভিষেকের পর তিনি খেলেছেন বোল্টন, চেলসি, বার্সেলোনা, মোনাকো, টটেনহামের মতো ইউরোপের শীর্ষ লিগের ক্লাবগুলোতে। মিডফিল্ডার ছিলেন মূলত, আক্রমণভাগেও খেলতে পারতেন। চেলসির হয়ে প্রিমিয়ার লিগ জিতেছেন দুইবার, বার্সেলোনার হয়ে লা লিগা, চ্যাম্পিয়নস লিগসহ স্প্যানিশ ক্লাব ফুটবলের প্রায় সব ট্রফি। আইসল্যান্ডের হয়ে ১৯৯৬ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ৮৮ ম্যাচে ২৬ গোল, দেশের হয়ে যুগ্ম শীর্ষ গোলদাতাও তিনি। বিশ্বকাপ ও ইউরোর বাছাইপর্বে নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশকে।
এইদুরের বাবা আরনরের জাতীয় দলে অভিষেক ১৯৭৯ সালে, খেলেছেন ১৯৯৭ পর্যন্ত। আইসল্যান্ডের হয়ে ৭৩ ম্যাচে ১৪ গোল করা এই স্ট্রাইকার ক্লাব ক্যারিয়ারে খেলেছেন আন্ডারলেখট ও বোর্দোর মতো দলে।
আরনরের আরেক ছেলে ও এইদুরের সৎভাই আরনর বর্গও ফুটবলার ছিলেন, তবে খুব বড় ক্লাবে খেলতে পারেননি। সোয়ানসির মতো ক্লাবে খেলেই থেমে গেছে ক্যারিয়ার।
এই পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে ফুটবলে পা রেখেছেন সভেইন অ্যারন গুদিয়নসন ২০১৫ সালে, আইসল্যান্ডের শীর্ষ লিগে অভিষেক, তিন বছর পর যোগ দেন ইতালির ক্লাব স্পেৎসিয়ায়। ওই সময় স্পেৎসিয়া সিরি বি-তে থাকলেও এই মৌসুমে উঠে এসেছে শীর্ষ লিগ সিরি আ-তে। তবে এবার ইতালির শীর্ষ লিগে খেলা হচ্ছে না সভেইনের। ক্লাব তাঁকে ধারে পাঠিয়েছে ডেনমার্কের তিনবারের চ্যাম্পিয়ন ওডেন্স বোল্ডক্লাবে।
সভেইনের আরও দুই ভাই আন্দ্রি ও ড্যানিয়েল ট্রিস্টান এখন আছেন যথাক্রমে সোয়ানসি ও রিয়াল মাদ্রিদের একাডেমিতে।