পাহাড়ঘেরা সবুজে মোড়া একটি ছোট্ট গ্রামে বাস করত আরিফ নামে এক বালক। গ্রামের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য—পাহাড়, নদী, আর ঝরনার গান—সবকিছুই যেন প্রাণের সুর হয়ে বাজত। কিন্তু এই সুন্দর পরিবেশে থেকেও আরিফের মন পড়াশোনায় বসত না। প্রতিদিন সে মাঠে খেলতে চলে যেত, নদীর ধারে বসে ভেসে যাওয়া নৌকাগুলোর দিকে তাকিয়ে সময় কাটাত, কিন্তু স্কুলের পড়াশোনা তার কাছে বিরক্তিকর লাগত।
গ্রামের স্কুলটির বড় বটগাছের নিচে ক্লাস হত। শিক্ষিকা মিস আসমা ছিলেন অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ও ধৈর্যশীল। তিনি লক্ষ্য করলেন, আরিফের মধ্যে প্রচুর মেধা আছে, কিন্তু সঠিকভাবে তার মনোযোগ আকর্ষণ করা দরকার। একদিন ক্লাস শেষে তিনি আরিফকে ডেকে বললেন, “আরিফ, কাল সকালে তুমি আমার সাথে একটু হাঁটতে যাবে?”
পরের দিন সকালে, আরিফ আর মিস আসমা হাঁটতে বেরোলেন। গ্রামটির পাশেই ছিল সবুজে মোড়া পাহাড়, যেখানে সূর্য ওঠার সাথে সাথে কুয়াশা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে, তারা এক ঝরনার ধারে এসে দাঁড়াল। ঝরনাটি পাহাড়ের ওপরে থেকে নিচে নেমে এসে নদীতে মিশে যাচ্ছিল। মিস আসমা আরিফকে বললেন, “এই ঝরনাটি দেখ, এটি কখনও থেমে থাকে না। পাহাড়ের যত বাধাই আসুক না কেন, এটি তার পথে অটল থেকে সামনে এগিয়ে যায়। জীবনেও যদি আমরা এগিয়ে যেতে চাই, তাহলে এই ঝরনার মতো হতে হবে। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও তোমাকে এভাবে এগিয়ে যেতে হবে, ধৈর্য আর পরিশ্রম করলে সফলতা আসবেই।”
আরিফ ঝরনার প্রবাহ দেখে মুগ্ধ হল। সে ভাবল, ঝরনাটি কিভাবে এত বাধা পেরিয়ে নিরলসভাবে চলে যাচ্ছে! তার মনে হলো, হয়তো পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়াটাও তেমনই হতে পারে—প্রথমে কঠিন, কিন্তু একবার পথ খুঁজে পেলে সহজ হয়ে যাবে।
পরে তারা গ্রামের নদীর দিকে হাঁটতে গেল। নদীটি শান্তভাবে বয়ে চলছিল, তার বুকে ছোট ছোট নৌকা ভেসে বেড়াচ্ছিল। মিস আসমা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে বললেন, “এই নদী যেমন তার গন্তব্যের দিকে শান্তভাবে চলে, তেমনই জীবনের যেকোনো সমস্যায় আমাদের মনে শান্তি ধরে রাখতে হবে। মনে যদি শান্তি থাকে, তাহলে তুমি পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পারবে, কঠিন জিনিসগুলোও সহজ হয়ে যাবে।”
আরিফ নদীর শান্ত প্রবাহ দেখে বুঝতে পারল, কেবল খেলাধুলা নয়, পড়াশোনাও উপভোগ করা যায় যদি ঠিকভাবে করা যায়। শিক্ষিকা তাকে আরও বললেন, “জীবনে পড়াশোনা ঠিক নদীর মতো—শান্ত আর নিরলস। যদি মনোযোগ দিয়ে কাজ করো, তবে যেকোনো বাধা পার হতে পারবে। পড়াশোনা যেমন তোমার খেলার জন্য দরকার, তেমনই জীবনের সাফল্যের চাবিকাঠি।”
প্রকৃতির এই শিক্ষা আর মিস আসমার উপদেশগুলো আরিফের মনে গভীর প্রভাব ফেলল। সে বুঝতে পারল, পড়াশোনা আর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে অধ্যবসায়, ধৈর্য, আর মনোযোগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এরপর থেকে আরিফ মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করল, আর প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান তার শিক্ষার অংশ হয়ে উঠল।
একদিন আরিফ মিস আসমার কাছে এসে বলল, “ম্যাডাম, আমি আগে পড়াশোনাকে বোঝা মনে করতাম, কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছি, এটা ঠিক ঝরনা আর নদীর মতো। যদি ধৈর্য ধরে মনোযোগ দিয়ে এগিয়ে যাই, তাহলে সাফল্য আসবেই।”
মিস আসমা মৃদু হেসে বললেন, “সফল হতে হলে ঝরনার মতো ধৈর্যশীল হতে হবে, আর নদীর মতো শান্ত থাকতে হবে। জীবনের পথে চলতে গিয়ে বাধা আসবেই, কিন্তু এগিয়ে চলাই আসল কৌশল। প্রকৃতির কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি।”
আরিফ ধীরে ধীরে তার পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে উঠল এবং পরীক্ষায় ভালো ফল করতে শুরু করল। বছরের শেষে সে যখন গ্রামের মধ্যে প্রথম হলো, তার বাবা-মা, শিক্ষক, এবং বন্ধুরা সবাই তাকে নিয়ে গর্বিত হলো। আরিফ বুঝতে পারল, প্রকৃতির যেমন নিজস্ব এক নিয়ম আছে, ঠিক তেমনই আমাদের জীবনেও নিয়ম মেনে ধৈর্য আর পরিশ্রমের সঙ্গে এগিয়ে গেলে সাফল্য আসবে।
এইভাবে প্রকৃতি আর শিক্ষকের ভালবাসা আরিফের জীবনের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল, যা তাকে জীবনজুড়ে নতুনভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।
সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, হাবীবুল্লাহ্ বাহার কলেজ, ঢাকা।