রাজধানীর একটি ব্যস্ত সড়কে সকালের দৃশ্য। একজন পেশাজীবী তাড়াহুড়ো করে অফিসে যাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ তার পায়ে ধাক্কা লাগলো। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেন, একটা ব্যাটারিচালিত রিক্সা তাকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেছে। এই ধরনের ঘটনা এখন রাজধানীতে প্রায় নিত্যদিনই ঘটছে। ব্যাটারিচালিত রিক্সার বাড়বাড়ন্ত এখন চরমে উঠেছে। সকাল ৮টা। ঢাকার একটি ব্যস্ত সড়কে জয়নাল মিয়া তার ব্যাটারি চালিত রিক্সা নিয়ে যাত্রী খুঁজছেন। হঠাৎ একটি তীব্র শব্দ শুনে তিনি চমকে উঠলেন। পেছন থেকে একটি বাস তার রিক্সাকে ধাক্কা দিয়েছে। জয়নাল মিয়া ও তার যাত্রী দুজনেই আহত হলেন। এই ঘটনা ঢাকার রাস্তায় এখন নিত্যদিনের চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রীষ্মের এক দুপুর। রাস্তার ধারে একটি স্কুল থেকে ছুটি পাওয়া শিক্ষার্থীরা রিক্সার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎই তীব্র বেগে ছুটে আসা একটি ব্যাটারি চালিত রিক্সা এসে তাদের মাঝখানে থেমে যায়। এক মুহূর্তের মধ্যেই স্কুলের ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা উঠে বসে। রিক্সার চালক জানেন না যে সামনের কয়েক কদমেই একটি বেপরোয়া বাস তাদের ঠিক পেছনে এসে পড়েছে। হঠাৎ গতি কমে গেলে বড় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা তৈরি হয়। এমন দৃশ্য এখন ঢাকার প্রতিটি প্রধান সড়কে অত্যন্ত পরিচিত।
বাংলাদেশের শহরগুলিতে ব্যাটারি চালিত রিক্সার সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই যানগুলি যাত্রীদের জন্য সুবিধাজনক ও সাশ্রয়ী হলেও, মেইন সড়কে এদের চলাচল নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নিরাপত্তা ও যানজট নিরসনের স্বার্থে মূল সড়কে এদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা সময়ের দাবি। ব্যাটারি চালিত রিক্সার প্রচলন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের পরে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে যখন সমাজের একশ্রেণির মানুষ আরও সহজ ও সাশ্রয়ী যাতায়াত ব্যবস্থার জন্য দাবি তোলে। কিন্তু এর প্রভাব যখন শহরের মূল সড়কে পড়তে শুরু করে, তখন তা বেশ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। মেইন সড়কে এই ব্যাটারি চালিত রিক্সাগুলোর চলাচল এখন শহরের যাতায়াত ব্যবস্থায় বড় সমস্যার জন্ম দিয়েছে।
বিশেষভাবে ঢাকার সড়কে যানবাহনের সংখ্যার আধিক্য এবং ক্রমবর্ধমান যানজটের সমস্যা আজ একটি বাস্তব চিত্র। বিশেষ করে ব্যাটারি চালিত রিকশাগুলো এখন ঢাকা শহরের মেইন সড়কে অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলাচল করছে, যা যানজট, দুর্ঘটনা, এবং নাগরিকদের জীবনযাত্রায় বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও ব্যাটারি চালিত রিকশা পরিবহন খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, মেইন সড়কে এদের অবাধ চলাচল বন্ধ করার সময় এসে গেছে। রাজধানী ঢাকার জন্য একটি সুসংহত ও কার্যকর যানবাহন নীতি প্রণয়ন এখন সময়ের দাবী।
ব্যাটারি চালিত রিক্সাগুলি প্রায়শই নিরাপত্তা মানদণ্ড মেনে চলে না। এদের অধিকাংশই রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়াই চলাচল করে। ব্যাটারি চালিত রিকশাগুলোর চালকরা সাধারণত কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই সড়কে যানবাহন চালান, যার ফলে সড়কে নিরাপত্তার বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়। প্রায়ই দেখা যায়, এসব রিকশার ফিটনেস সার্টিফিকেট বা রেজিস্ট্রেশন নেই। তাছাড়া, চালকরা ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা বা যত্রতত্র থেমে যাত্রী ওঠা-নামানোর প্রবণতায় যুক্ত থাকেন। এর ফলে যানবাহনগুলো ধীরগতির হয়ে পড়ে এবং অন্য যাত্রীবাহী গাড়ির জন্য রাস্তায় বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত বছরে শুধু ঢাকা শহরেই ব্যাটারি চালিত রিকশার কারণে প্রায় ৫০০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে অনেকেই আহত হয়েছেন।
ঢাকা শহরের যানজট সমস্যার পেছনে ব্যাটারি চালিত রিকশার একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। মেইন সড়কে দ্রুতগতির বাস, ট্রাক, এবং প্রাইভেট কারের মাঝে ধীরগতির রিকশার চলাচল যানবাহনের স্বাভাবিক গতি কমিয়ে দেয়। ব্যাটারি চালিত রিকশার সীমিত গতি এবং যত্রতত্র থামার প্রবণতা মেইন সড়কের যানজটকে বাড়িয়ে দেয়। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মেইন সড়কে ব্যাটারি চালিত রিক্সার চলাচল যানজট ১৫-২০% বাড়িয়ে দিয়েছে । এই যানগুলি ধীরগতির হওয়ায় অন্যান্য যানবাহনের গতিপথে বাধা সৃষ্টি করে।
ব্যাটারি চালিত রিকশা আপাতদৃষ্টিতে পরিবেশবান্ধব বলে মনে হলেও, এর ব্যাটারি উৎপাদন ও নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া প্রকৃতপক্ষে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতি বছর প্রায় ১০,০০০ টন ব্যাটারি বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার বেশিরভাগই অবৈজ্ঞানিকভাবে নিষ্পত্তি করা হয়। ব্যাটারি বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় মাটি ও পানির দূষণ এবং জনস্বাস্থ্যের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে। যদিও ব্যাটারি চালিত রিক্সা তাৎক্ষণিকভাবে কম দূষণ সৃষ্টি করে, কিন্তু এর ব্যাটারি উৎপাদন ও নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ।
এখনও পর্যন্ত ব্যাটারি চালিত রিকশার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামো নেই। এর ফলে রাজধানীর প্রধান সড়কে এই রিকশাগুলোর চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা একটি নীতিমালা প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় আছেন যেখানে মেইন সড়কে এদের চলাচল নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকবে। তবে, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে এটি জননিরাপত্তা ও যানজট সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলবে।
দ্য ডেইলি স্টারের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ব্যাটারি চালিত রিক্সাগুলো সাধারণত অত্যন্ত ধীরগতির হয়, যা মূল সড়কে অন্যান্য যানবাহনের স্বাভাবিক গতির সাথে সাংঘর্ষিক। সড়কে চলাচলরত বাস, ট্রাক বা ব্যক্তিগত গাড়িগুলো যেখানে নির্দিষ্ট গতিতে ছুটছে, সেখানে ধীর গতির এই রিক্সাগুলো যানজটের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ব্যস্ত সময়ে রিক্সার কারণে যাত্রীরা অনেক সময় আটকে পড়েন, এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে অপেক্ষা করতে হয়। এ তথ্য প্রতিদিনের নাগরিক জীবনযাত্রায় সবারই পরিচিত।
বাংলাদেশ ট্রাফিক পুলিশের তথ্যমতে, এই রিক্সাগুলোর চালকরা বেশিরভাগই প্রশিক্ষণহীন, ফলে তারা ট্রাফিক আইন মানতে ব্যর্থ হন। ট্রাফিক সিগনাল অমান্য করা, নির্দিষ্ট লেনের বাইরে চলা এবং যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামানোর প্রবণতা এখন সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, যা বিশেষভাবে চিন্তার বিষয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, ব্যাটারি চালিত রিক্সার প্রযুক্তিগত সমস্যাগুলোও কম নয়। নিম্নমানের ব্যাটারি ব্যবহার এবং রিক্সার অব্যবস্থাপনার ফলে তা সড়কের মাঝে বিকল হয়ে যাওয়া কিংবা দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। বিশেষ করে ব্যাটারি ফেটে যাওয়া কিংবা শর্ট সার্কিটের ঝুঁকি থাকায় এটি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। মূল সড়কে এতসব ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনের চলাচল যে কতটা বিপজ্জনক, তা আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে না।
ব্যাটারি চালিত রিকশার মেইন সড়কে চলাচল বন্ধ করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত, সরকারের উচিত মেইন সড়কে এই রিকশাগুলোর চলাচল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা। প্রধান সড়কগুলোতে উচ্চ গতিসম্পন্ন যানবাহনের সাথে ধীরগতির রিকশার সহাবস্থান দুর্ঘটনা ও যানজটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই মেইন সড়ক থেকে এসব রিকশা সরিয়ে অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোতে নির্দিষ্ট রুট নির্ধারণ করে তাদের চলাচল সীমিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ব্যাটারি চালিত রিকশার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নিরাপত্তা মানদণ্ড প্রণয়ন করা আবশ্যক। চালকদের জন্য সঠিক প্রশিক্ষণ এবং লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা উচিত যাতে তারা সড়কে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে সক্ষম হয়। রিকশার ফিটনেস ও প্রযুক্তিগত মান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা রোধ করা যায়। পরিবেশের সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে ব্যাটারির ব্যবহারের ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এতে করে ব্যাটারি বর্জ্য সঠিকভাবে নিষ্পত্তি হবে এবং পরিবেশের ক্ষতি কমবে।
রাজধানী ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও যানবাহনে পূর্ণ একটি শহরে ব্যাটারি চালিত রিকশার মেইন সড়কে অবাধ চলাচল বন্ধ করা এখন সময়ের দাবী। এটি শুধু সড়ক দুর্ঘটনা কমাবে না, বরং যানজট ও পরিবেশ দূষণকেও কমিয়ে একটি সুস্থ, নিরাপদ এবং সুশৃঙ্খল নগর পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। সরকার, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, এবং সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের একত্রে কাজ করে এ সমস্যার সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
সরকারের উচিত দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে মেইন সড়কে ব্যাটারি চালিত রিকশার চলাচল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা। তবে, এ নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি কিছু কার্যকর পদক্ষেপও নেওয়া জরুরি। প্রথমত, ব্যাটারি চালিত রিকশার জন্য শহরের অভ্যন্তরীণ ছোট রাস্তাগুলোতে সুনির্দিষ্ট রুট নির্ধারণ করতে হবে, যাতে তারা নির্ধারিত এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে এবং মেইন সড়কের যানবাহনের সাথে সংঘর্ষ এড়ানো যায়। দ্বিতীয়ত, রিকশাগুলোর জন্য ফিটনেস পরীক্ষা ও রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং সড়ক নিরাপত্তা মানদণ্ড কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। চালকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের ট্রাফিক আইন মেনে চলার জন্য সচেতন করতে হবে, যাতে সড়কে দুর্ঘটনা কমে। পাশাপাশি, চালকদের উন্নত ও পরিবেশবান্ধব ব্যাটারি প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং সঠিকভাবে ব্যাটারি নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এই পদক্ষেপগুলো সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে, সড়ক নিরাপত্তা, যানজট এবং পরিবেশ দূষণের সমস্যা অনেকাংশে কমে আসবে।
শহরের রাস্তায় আর কতো জয়নাল মিয়ার মতো দুর্ঘটনার শিকার হতে হবে? কতো মানুষকে যানজটে আটকে অমূল্য সময় নষ্ট করতে হবে? আমাদের শহরগুলিকে বাসযোগ্য ও নিরাপদ করে তুলতে হলে ব্যাটারি চালিত রিক্সার অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। এটি শুধু আমাদের বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে।
সহযোগী অধ্যাপক, মার্কেটিং
হাবীবুল্লাহ্ বাহার কলেজ, ঢাকা।