34খোলা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি। একটি উড়োজাহাজ ধীরগতিতে এগিয়ে আসছে। যত কাছে আসছে ভেতরের চঞ্চলতা তত বাড়ছে। এক সময় চাকা থেমে গেল। মন আনচান করে উঠল। ওঠার জন্য অস্থির হয়ে আছি। কিন্তু তারা যেতে দিল না। যান্ত্রিক ত্রুটি আছে। উড়বে কিনা আপাতত বলতে পারছে না। সময় লাগবে। প্রচন্ড গতিতে ধাবমান কিছুকে যেন হঠাৎ আচমকা থামিয়ে দেওয়া হলো। খুশির প্রবাহ স্থির হয়ে গেল। সব প্রস্তুতি সুসম্পন্ন করার পরও আগের বার যাওয়া যায়নি। বিশ্বব্যাপী করোনার আগ্রাসন থামিয়ে দিয়েছিল সে যাত্রাকে।
করোনার পর যখন যাত্রার নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হলো তখন সামনে দেখা দিল ২টি সমস্যা। আম্মা ও খালাম্মার বয়স নির্ধারিত সীমার চেয়ে অনেক বেশি। আবার যে অর্থ করোনার আগে সংগ্রহ করা হয়েছিল তা আর যথেষ্ট থাকল না। টাকার পরিমাণ অনেক বেড়ে গেল। সময়ের ব্যবধানে বয়সের শর্ত শিথিল হলো। যার আঙিনায় যাচ্ছি তিনি অর্থের ব্যবস্থা করে দিলেন অপ্রত্যাশিতভাবেই। উড়োজাহাজের দরজার কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আবারও বাধা মনকে আহত করল। ভেঙে পড়লাম। তাহলে কী আমার আর…।
করোনারও প্রায় ৫ বছর আগে একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা পেয়ে পাসপোর্ট করেছিলাম। তখন ছিল জীবনের প্রথম সম্ভাবনার স্বপ্ন। ভেবেছিলাম কাছে যেতে পারব, সরাসরি দেখতে পারব। কিন্তু সেবারও…। এতটা বছর পাসপোর্টটাকে আগলে রেখেছি। প্রতিবার মৌসুম আসলে ভাবতাম…। দেখতে দেখতে পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেল। কিন্তু এবার তো উড়োজাহাজের দোরে। অপেক্ষার অনেক সময় চরম উৎকণ্ঠায় কাটাতে লাগলাম। ভেতরে ভেতরে জ¦লন, দহন আর মিনতি : এভাবে বারবার ফিরিয়ে দিও না। অন্যের প্রত্যাখ্যান সয়ে নেওয়া যায়, নিতে পারব। কিন্তু তোমার এ বারবার ফিরিয়ে দেওয়ার ভার অনেক ভারি হয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৫ ঘণ্টা পর ডাক এলো চড়ার জন্য। আত্মায় পানি ফিরে পেলাম। গ্রীষ্মের শুষ্ক মাটিতে এক পশলা বৃষ্টি হলো।
মনিটরে সফরের দোয়াগুলোর লেখা ভেসে উঠল। স্পিকার থেকে আরবীয় ভরাট কণ্ঠে দোয়াগুলোর উচ্চারণ ভেসে এলো। আবৃত্তি করে নিলাম। মনে মনে ভাবলাম, ওদের লাল উড়োজাহাজ প্রিয়নবীর সুন্নত দোয়াগুলোকে যেভাবে স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের সবুজ উড়োজাহাজ কি তা করে! নাকি অন্য কিছু করে। ভরদুপুরে নামলাম শারজা বিমানবন্দরে। আসা-যাওয়া দুবারই যাত্রাবিরতি ছিল এখানে। এত বড় বিমানবন্দর। কিন্তু কিছু অব্যবস্থাপনা আছে। যা আমাদের ভুগিয়েছে।
বিমান সামনে যাচ্ছে ভালোবাসার উপলব্ধির উত্তাপ বাড়ছে। খালি ভাবছি আর কতকক্ষণ পর দেখতে পারব। বিমানের জানালা দিয়ে দেখছি সূর্য নিচে নামছে আমাদের বিমানও তখন নিচে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সময় গণনার ইসলামি রীতিতে দিবসের সূচনা সূর্যাস্ত থেকে। এ হিসেবে একটি নতুন দিবসের সূচনালগ্নেই পবিত্র দেশের কোলে স্থান পেয়ে ধন্য অনুভব করলাম নিজেকে। চারদিকের সবকিছু অতি আগ্রহের সঙ্গে দেখতে লাগলাম। ইমিগ্রেশনের সারিতে দাঁড়ালাম আমি, আম্মা ও খালাম্মা। একজন পুলিশ এসে আমার আম্মা ও খালাম্মাকে জিজ্ঞেস করলেন মুখ খোলতে আপত্তি আছে কিনা? তাদের হয়ে আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি আম্মা ও খালাম্মাকে নিয়ে গেলেন ডান পাশের দেয়াল ঘেঁষে স্থাপিত মহিলা অফিসারের কেবিনে। তারা ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে এলেন কিন্তু কোনো পরপুরুষের সামনে মুখ খোলতে হলো না। একটি স্যাকুলার দেশে বড় হওয়া আমি এ দৃশ্য দেখে বড়ই অবাক হলাম, মুগ্ধ হলাম। আমাদের দেশের চেয়ারে বসা মানুষগুলো মুখাবৃত নারী দেখে চরম বিরক্তি প্রকাশ করে। পর্দানশিন মা, বোন, স্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের ব্যবস্থাতে কত জাগায় যে হেনস্থা হতে হয় বা হয়েছি! তা বলার মতো নয়। আশা করি সময়ের পালা পরিবর্তন হবে। আলো আসবে এ দেশে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা নাগরিকদের পছন্দ, পোশাক ও ধর্মচর্চার প্রতি আন্তরিক, শ্রদ্ধাশীল ও সহযোগী হবে।
মধ্যরাতে বাস আমাকে রেখে দিল বালাদুল আমীন (নিরাপদ নগরী) মক্কার পবিত্র কোলে। শিহরিত হলাম। কোথায় আছি! স্বপ্নের দেশে। হ্যাঁ, স্বপ্নের দেশ। নানা-নানি এ স্বপ্ন গেঁথে দিয়েছিলেন সেই অবুঝ শৈশবে। তারা স্বপ্ন দেখতেন এ মাটিতে গড়িয়ে পরার, লুটিয়ে পরার। সেই স্বপ্ন তারা পূরণ করে না গেলেও তারা তাদের স্বপ্নে সফল। তারা তাদের স্বপ্নকে নিজেদের সন্তান ও অবুঝ নাতিদের মাঝে জাগিয়ে গেছেন। তারা দেখেননি মক্কার মাটি। কিন্তু তারা গল্প বলতেন মক্কার অলিগলির। তারা গল্প বলতেন মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শৈশবের, কৈশোরের, তারুণ্যের। তারা আমাদের গল্প বলতেন শিশু ইসমাইলের ও তার মা হাজেরার। গল্পে গল্পে তারা আমাদের মনের গহিনে যে চেতনা রেখে গেছেন তার নাম মক্কার ভালোবাসা, মদিনার ভালোবাসা। আমাদের সেই সংস্কৃতি কি এখনো জীবিত আছে? এখনকার নানি-দাদিরা কি এ যুগের শিশুদের কাছে মক্কা-মদিনার গল্প শোনান? প্রিয়নবী ও তার সাহাবিদের গল্প শোনান?
মক্কাতে পৌঁছার পর দেখার বিলম্ব কি আর মনে মানে! সব মিলিয়ে প্রায় ২০ ঘণ্টার ধকল। খুবই সংকীর্ণ পরিসরে হাঁটু সোজা না করে, না শোয়ে এখন আসলাম বিছানার পাশে। কিন্তু বিছানা শরীরকে টানতে পারল না। আম্মা আর খালাম্মাও দেরি করতে রাজি না। বিছানায় যেতে রাজি না। বিস্মিত হলাম তাদের ভালোবাসার শক্তির ওপর। মুআল্লিমের সঙ্গে হোটেল থেকে বের হলাম। গভীর রাত। রাস্তায় প্রচুর মানুষ। সামান্য একটু হাঁটার পরই পেলাম সেই ফটক। যা স্থির চিত্রে ও চলচ্চিত্রে অগণিতবার দেখেছি আর অস্থিরতা অনুভব করেছি যে, কবে এ ফটক দিয়ে প্রবেশের ডাক শোনতে পাব।
আজ স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে, অস্থিরতা প্রশমিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু অস্থিরতা আরও বাড়ছে। যতই ভাবছি এই তো এসে গেছি ততই আরও অস্থির হচ্ছি। হৃদয়ে আরও প্রবল ঝড় উঠছে। ভয় পাচ্ছি কেমন হবে জীবনের প্রথম দেখা। গুছিয়ে বলতে পারব তো।
ভীত মনে, কম্পিত পায়ে লাখো মানুষের সঙ্গে এগোচ্ছি। সিঁড়ি দিয়ে অর্ধেক নামতেই দেখা মিলল। জীবনের প্রথম দেখা। হারিয়ে ফেললাম নিজেকে। উৎকণ্ঠায়, আবেগে, পুলকে সব ভুলে গেলাম। হাদিস ও ফিকহের কিতাবে পড়া এ সোনালি মুহূর্তের করণীয় কিছুই মনে থাকল না। কিছু যে করতে হবে, বলতে হবে সব ভুলে গেলাম। এমনকি মনে করার কথাটাও মনে থাকল না। কেমন যেন ভাবলেশহীনভাবে তাকিয়ে থাকলাম। অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকলাম। ‘অপলক’ শব্দটার জনম সেদিন স্বার্থক হয়েছে। তাকিয়েছিলাম। কতক্ষণ? হিসাব নেই। হিসাব থাকবে কীভাবে। এ সময় তো সময় থেমে যায়। বহু বহু ক্ষণকে মনে হয় অতিসামান্য মুহূর্ত মাত্র। প্রস্তুতি ছিল কিছু বলার কিন্তু বলতে পারলাম না। বলা আর হলো না। মানুষের তাড়ায় নড়তে হলো। বিরক্ত বোধ করলাম। আর কেউ না থাকত। কিন্তু তা তো আর হওয়ার নয়। হবেও না কোনো দিন। খেয়ালি মন কত কিছুই তো ভাবে। আল্লাহ! মাফ করো।
নিচে নামলাম। কাছে যেতে লাগলাম। ঘোরতে লাগলাম। অনেক মানুষের প্রচ- ভিড়। এক হাতে আম্মাকে আরেক হাতে খালাম্মাকে ধরে যথাসম্ভব ভিড় এড়িয়ে অনেক দূর দিয়ে এগোতে লাগলাম, ঘোরতে লাগলাম। বার্ধক্যজনিত দুর্বলতা এবং বিভিন্ন রোগে অন্যদের তালে হাঁটা তাদের দুজনের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তাই মুয়াল্লিম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। তাদের সামর্থ্যরে দিকে লক্ষ্য রেখে তাদের গতিতে তাওয়াফ শেষ করলাম। পেট ভরে, মন ভরে জমজমের পানি পান করলাম। সাইনবোর্ড দেখে দেখে সাফা পাহাড়ে পৌঁছে সাফা-মারওয়া যাতায়াত শুরু করলাম। খালাম্মার বয়স আম্মার চেয়ে অনেক বেশি। তিনি কতক্ষণ পরপর বসে যান। পানি পান করেন। বিশ্রাম নেন। একটানা হাঁটা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। সাফা-মারওয়া যাতায়াতের মাঝেই পড়ে নিলাম ফজরের নামাজ। সাত দিন পর আবার শেষ দেখা দেখে নিলাম। মন ভরে দেখার চেষ্টা করলাম। মন ভরল না। বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় অশ্রুসিক্ত হয়ে পরলাম। ভেতরে পোষে রাখলাম অতৃপ্তি, আবার আসার, আবার দেখার, আবার কাছে বসার বাসনা। বিদায় নিলাম। আসলে তো নিলাম না। নিতে হলো।
বাস এগিয়ে চলল সোনার মদিনার পানে। মন আবারও নতুন করে অস্থির হতে লাগল। গভীর রাতে হোটেলে নেমেই গোসল করে, কাপড় বদলে নিজেকে ধীরস্থিরে শান্ত করে এগোতে থাকলাম। নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, জানো কোথায় যাচ্ছ? কার পদতলে যাচ্ছ? তিনি আমার মনে যতটা না মহান হয়ে ভাসলেন তার চেয়ে বেশি আপন হয়ে, পরম উপকারী বন্ধুসুলভ অভিভাবক হয়ে ভাসলেন। আমার জন্ম, শৈশব, বেড়ে ওঠা, শিক্ষা-দীক্ষা, প্রতিষ্ঠিত হওয়া, সবকিছুতেই অনুভব করতে লাগলাম তার রুহানি উপস্থিতি, তার অবদান। তিনি আমার জীবনে কখন নেই, কোথায় নেই? আমার প্রতিটি কাজে তিনি আমার সঙ্গে থাকেন। কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে, কোন পদ্ধতি আমার জন্য সবচেয়ে সুন্দর তা তিনি আমাকে বলে দেন, শিখিয়ে দেন। তিনি তার শিক্ষা দিয়ে আমার সঙ্গে থাকেন সবসময়। জীবনের এতটা বসন্ত পারি দেওয়ার পর আজ সুযোগ পেতে যাচ্ছি তার উপস্থিতির কাছে দাঁড়ানোর। আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠতে লাগলাম। ঠিক সোজা বরাবর এসে আর নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না। চোখ আমার কথা শোনল না। আর শোনানোর চেষ্টা করলাম না। চোখকে তার কাজ করতে দিলাম। ফোঁটাগুলো গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। কাঁদতে পেরেই যেন ভালো লাগছে। কম্পিত কণ্ঠে সালাত ও সালাম নিবেদন করলাম। সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলা আলিহি ওয়া সাল্লাম। একটি প্রশ্ন মনে নিয়ে দেশে ফিরলাম, শোয়ে-বসে কালো গিলাফ আর সবুজ গম্বুজ দেখার সুযোগ কি আরও হবে?
মুফতি মাহফূযুল হক