কলকারখানার তরল বর্জ্যের কারণে রাজধানীর নদীগুলোর পানি প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে। এরফলে পানি ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ার পাশাপাশি বহুমুখী সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই পানির ইকোসিস্টেম ঠিক রাখতে এখনই সম্মিলিত প্রচেষ্টার দরকার মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. আখতার হোসেন খান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নদীর পানি দূষণের জন্য এককভাবে কাউকে দায়ী করা যাবে না। কলকারখানার মালিক, নাগরিক এবং সরকারি সংস্থার যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত আমরা সবাই দায়ী। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই দূষণ বন্ধ করা সম্ভব নয়।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্ষাকালে নদীতে পানির প্রবাহ বাড়ে এবং শীতকালে নদীতে ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। কখনো নদী একেবারে শুকিয়ে যায়। নদীতে পানির প্রবাহ নির্ভর করে ঋতু, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও উজানের প্রবাহের ওপর। পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৭৩ সাল থেকে ভূপৃষ্ঠস্থ পানির মান পরিবীক্ষণ করে আসছে। নদীর পানির গুণগত মান পরিবীক্ষণ কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধি করে ৩০টি নদীর ৯৯টি স্থানের পানির গুণগত মান নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে।
পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ঢাকা শহরের চারপাশের নদীগুলো শুষ্ক মৌসুমে চার থেকে পাঁচ মাস খুব দূষিত থাকে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে তিন মাস (জানুয়ারি-মার্চ) পর্যন্ত দ্রবীভূত অক্সিজেন (DO) প্রায় শূন্য। পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩ অনুসারে, মৎস্য চাষে ব্যবহার্য পানির DO≥ ৫। বর্ণিত ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, নদীর পানির গুণগত মান পরিবেশগত মানমাত্রার মধ্যে নাই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীর পানি দূষণের পেছনে কলকারখানার তরল বর্জ্য অনেকাংশে দায়ী। এখনো ট্রিটমেন্ট ছাড়াই সরাসরি সুয়ারেজের লাইন নদীতে পড়ছে। ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের কণা পানি দূষণের পাশাপাশি মাছের দেহে ঢুকছে। যা খাবার চেইনের মাধ্যমে মানবদেহে চলে আসছে।
অন্যদিকে নদীর পানির পাশাপাশি সমুদ্রের পানিতেও দূষণ বাড়ছে। সমুদ্র নিয়ে গবেষণায় যুক্তরা জানান, সমুদ্রের পানি যদি দূষিত হয়, সেখানে যে জীববৈচিত্র্য আছে সেটা ধ্বংস হবে। ফলে মানুষের ভূমিতে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ ৬০ ভাগ অক্সিজেন আসে সমুদ্র থেকে। সমুদ্রের পানি যে দূষণ হচ্ছে সেটা অক্সিজেনের স্বল্পতা তৈরি করছে। কার্বন দূষণের মাধ্যমে যে গরম তৈরি হচ্ছে সেটা এই পানিগুলো শুষে নিত। এখন সেটি নষ্ট হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. কেএম আজম চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সমুদ্রের পানির মান ধরে রাখা আমাদের দরকার। কিন্তু আমরা ইচ্ছামতো ময়লা ফেলছি, শিল্পকারখানার ময়লা সরাসরি ছেড়ে দিচ্ছি। গরম পানি ছেড়ে দিচ্ছি। মাইক্রো প্লাস্টিক দিচ্ছি। সবগুলো বৃষ্টির মাধ্যমে ভূমি থেকে নদী হয়ে সমুদ্রে যাচ্ছে। সমুদ্রের বিশাল এলাকা দূষিত হয়ে পড়ছে। এটা যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে ২০৫০ সালে গিয়ে দেখা যাবে মাছের চেয়ে প্লাস্টিক বেশি হয়ে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানি কমে যাচ্ছে। ফলে ভূমি ধসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। একইসঙ্গে দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে। পানির যে চক্র বাষ্প থেকে মেঘ হবে, মেঘ হয়ে বৃষ্টি পড়বে আবার প্রাকৃতিকভাবে ফিল্টারিং হয়ে পাতালে জমা হবে। পাতাল থেকে আবার আমরা পানি তুলে নিচ্ছি। এই চক্রও ধ্বংস হচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং (বৈশ্বিক উষ্ণতা)সহ নানা কারণে। পানির ইকোসিস্টেম নষ্ট হওয়া মানে সকল প্রাণী, উদ্ভিদের জীবন ব্যাঘাত হওয়া। এটা হলে গোটা পৃথিবী ধ্বংসের পথে যাবে। এ জন্য আমাদের সব ধরনের পানির উৎস দূষণমুক্ত রাখতে হবে।’