রাজধানী ডেস্ক:
রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ছাড়াও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটজুড়ে এখন শুধু কান্নার রোল। ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসা বিলাপে গুমোট চারপাশের পরিবেশ। ছলছল চোখে কেউ সন্তানের, কেউবা স্ত্রীর, কেউ বন্ধুর আবার কেউবা আপনজনের লাশ নিতে ভিড় করছেন হাসপাতাল প্রাঙ্গণে। প্রিয়জনের মরদেহ বুঝে নিতে শুক্রবার (১ মার্চ) ভোররাত পর্যন্ত মর্গের সামনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায় তাদের।
বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) রাতের ভয়াবহ আগুনে নারী-শিশুসহ একে একে ঝরেছে ৪৫ প্রাণ। এছাড়াও আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সবার অবস্থাই আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন। আগুনের খবর পেয়ে রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়াও বার্ন ইউনিট পরিদর্শন করেন তিনি। পরে সাংবাদিকদের ৪৫ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সেই সঙ্গে আহতদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা নিশ্চিতের আশ্বাস দেন।
এদিকে, ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রিয়জনদের হারিয়ে পাগলপ্রায় স্বজনরা। মরদেহ বুঝে নিতে অপেক্ষারত অবস্থায় ক্ষণে ক্ষণে বিলাপ করছেন। মর্গের সামনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা আরাফাত জানান, ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বন্ধু আসিফ। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায়। পড়ালেখা করতো কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিতে। মরদেহ বুঝে নিতে মর্গের সামনে অপেক্ষা করছেন তিনি।
অন্যদিকে, একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় শিপনের বাবা মর্গের সামনে ক্ষণে ক্ষণে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। পাশেই থাকা এক নিকটাত্মীয় তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। ক্ষণে ক্ষণে শিপনের বাবা শুধু বলছেন, ‘আমার একমাত্র বাবা রে। আমার আব্বা (শিপনের দাদা) মরছে, কালকে আমার আব্বার মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের দিনে আমার বাবা (শিপন) আমারে ছাইড়া গেল।’
অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৪৫ জনের মধ্যে চারজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন- আলিশা, নাহিয়ান, লামিয়া ও তানজিলা। তাদের মরদেহ অন্য মরদেহগুলোর সঙ্গে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে রয়েছে। এছাড়াও ঢাকা মেডিকেলে ৩৩টি মরদেহ রয়েছে। জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে তিন শিশু ছাড়াও ১৯ জন নারী রয়েছেন।
অন্যদিকে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে সভাপতি করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে। এছাড়া কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট জোনের ডিএডি, সিনিয়র স্টেশন অফিসার এবং ওয়ারহাউজ ইন্সপেক্টরকে কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৫০ মিনিটের দিকে বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে আগুন লাগে। পরে ৯টা ৫৬ মিনিটের দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট। পরবর্তীতে ইউনিট বাড়ার পাশাপাশি আগুন নিয়ন্ত্রণে ৩ প্লাটুন সাধারণ আনসার ছাড়াও বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১ প্লাটুন আনসার গার্ড ব্যাটালিয়ন (এজিবি) সদস্য মোতায়েন করা হয়।
তারা ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণ ও আটকে পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করতে কাজ করে। এছাড়াও উদ্ধার কার্যক্রমে যোগ দেয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরাও। একপর্যায়ে দুই ঘণ্টা চেষ্টার পর রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, আগুন লাগা সাত তলা ভবনটির বেশিরভাগ ফ্লোরেই বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ছিল। ঘটনার সময় ওই রেস্টুরেন্টে অনেকে শিশু সন্তান, স্ত্রী ছাড়াও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খাবার খাচ্ছিলেন। দ্বিতীয় তলায় আগুন লাগার পর ৭ তলা ওই ভনটিতে আটকে পড়েন অনেকে। পরে তাদের অনেকেই সাত তলার ছাদে আশ্রয় নেন। তবে রেস্টুরেন্টগুলোয় একাধিক সিলিন্ডার থাকায় দ্রুতই পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে আগুন।
ঘটনার পর প্রথমেই তিনজনের মরদেহ উদ্ধার ছাড়াও ৭৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। সেই সঙ্গে অচেতন অবস্থায় ৪২ জনকে ঢাকা মেডিকেল, শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিট ছাড়াও রাজারবাগের পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে পাঠায়। পরবর্তীতে একে একে নারী-শিশুসহ ৪৫ জনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।